০৩ মে ২০২৪, শুক্রবার, ০১:৫০:০৮ পূর্বাহ্ন


মৃত মানুষদের নিয়ে অদ্ভুত উত্‍সব!
এক্সক্লুসিভ ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৮-২০২৩
মৃত মানুষদের নিয়ে অদ্ভুত উত্‍সব! ছবি: সংগৃহীত


আফ্রিকার একটি অদ্ভুত দেশ মাদাগাস্কার। পুরো দেশটাই ভৌগোলিক ভাবে একটি দ্বীপ এবং আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বীপগুলির তালিকায় এই দেশটির অবস্থান চতুর্থ। এই দেশেরই একটি অদ্ভুত উত্‍সবের নাম ফামাদিহানা।

এটি এমন একটি উত্‍সব যে, এখানে বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে মাটির নীচ থেকে পরিবারের মৃত সদস্যদের মৃতদেহ উত্তোলন করা হয়। তারপর পুরো এলাকায় সেই মৃতদেহ নিয়ে নাচ গান করা হয়। একটি পরিবারে প্রায় সব সদস্যই এই উত্‍সবের সময় একত্রিত করা হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটি পরিবারের সমস্ত সদস্য মিলিয়ে সংখ্যাটি ২০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দু'শতধিক মানুষের খাওয়া-দাওয়ার ব্যয়ভার বহন করা বেশ ব্যয়বহুল একটি ব্যাপার। তাই উত্‍সবের আগেই একটি পরিবার প্রায় বছর খানেক ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

আফ্রিকার মৃতদেহকে কেন্দ্র করে যেসব লোকাচারের প্রচলন রয়েছে, সে সবের মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত বোধ হয় মাদাগাস্কারের এই ফামাদিহানা। মাদাগাস্কারের মানুষকে কবর দেওয়ার বিষয়টিও বেশ অদ্ভুত। দ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ তাদের পরিবারের জন্য দুটি কবর খনন করেন; একটি কবরে থাকে শুধু পরিবারের নারী সদস্যদের মৃতদেহ, অপরটিতে থাকে পুরুষ সদস্যদের মৃতদেহ। নারীদের কবরে কখনও ভুলেও পুরুষদের শায়িত করা হয় না। ঠিক একইভাবে পুরুষদের কবরে ভুলেও নারীদের শায়িত করা হয় না। তবে শুধু মাত্র স্বামী স্ত্রী ক্ষেত্রে এই নিয়ম শিথিল করা হয়েছে।

প্রতিটি পরিবার কবরের পেছনে বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করে থাকে। এটা এতই বেশী যে, তাদের বাড়ির যে গত হওয়া মানুষদের কবর বেশী ব্যয়বহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। কারণ মাদাগাস্কারে ধরে নেওয়া হয়, যার বাড়ির সাথে সংযুক্ত কবর যত বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ও দামী তার সামাজিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য তত উঁচুতে।

ফামাদিহানা উত্‍সবের আয়োজন করা হয় সাধারণত জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। এই সময় মাদাগাস্কার দ্বীপে শীত থাকে। একজন স্থানীয় জ্যোতির্বিদের মাধ্যমে সময় ঠিক করে নেওয়া হয়। বর্ষাকালে বৃষ্টির আশঙ্কা থাকে এবং গ্রীষ্মকালে উষ্ম আবহাওয়ায় মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে নাচ-গান করা বেশ কষ্টের কাজ, এই জন্য শীতকালকে বেছে নেওয়া হয়। উত্‍সবের সময় কবর থেকে পরিবারের মৃত সদস্যের দেহ উত্তোলন করা হয়। সেই কঙ্কাল উত্তোলনের পর নতুন সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে কোনও ম্যাটের ওপর রাখা হয়। পরিবারের সদস্যরা সাধারণত সেই ম্যাটের বিভিন্ন প্রান্ত ধরে থাকেন। ম্যাট ও সাদা কাপড় দুটোতেই সুগন্ধি মাখানো হয় এবং মাখানো হয়ে গেলে ওইগুলো পবিত্র হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

দেহ উত্তোলন করার জন্য যখন কবরের ভেতর প্রবেশ করা হয়, তখন সবার হাতে মোমবাতি থাকে। দেহটি উত্তোলনের পর যখন নাচ গানের পর্ব শুরু হয়, তখন যারা মরদেহবাহী ম্যাটের বিভিন্ন প্রান্ত ধরে থাকেন তারা বেশ সতর্ক থাকেন, যাতে সাদা কাপড়ে মোড়ানো কঙ্কাল কোনও ভাবেই মাটিতে পড়ে না যায়। মাদাগাস্কার দ্বীপের আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন, পরিবারের কোনও সদস্যকে যদি বাড়ি থেকে দূরে কোথাও কবর দেওয়া হয়, তাহলে সেটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। আরও বিশ্বাস করা হয়, যদি ফামাদিহানা উত্‍সবের সময় মৃত ব্যক্তির দেহের সাথে ভালো ব্যবহার না করা হয়, তবে পর জন্মে অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।

ফামাদিহানাকে দেখা হয় একটি উপলক্ষ হিসাবে সে সময় পরিবারের মৃত সদস্যরা জীবিতদের সাথে একত্রিত হতে পারেন। আমাদের এই উপমহত্‍সবের মৃত ব্যক্তির লাশের সাথে অনেক শোক জড়িয়ে থাকে। যখন কোনো ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হয় কিংবা চিতায় পোড়ানো হয়, তখন পরিবেশ আবেগময় হয়ে উঠে। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনেরা অতীতের বিভিন্ন স্মৃতির কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মাদাগাস্কারে পুরো উল্টো ঘটনা ঘটে। যখন কবর থেকে নিজের মৃত সদস্যের দেহ উত্তোলন করা হয়, তখন সবাই হাসতে থাকেন। সেখানে মৃত্যু কোনও শোকের বিষয় নয়।

আগেই বলা হয়েছে, এই উত্‍সব ব্যয়বহুল। মৃত ব্যক্তির সমস্ত ব্যক্তিকে ডাকা হয় এবং প্রায়ই সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। ফামাদিহানা চলে প্রায় দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত। যিনি আয়োজন করেন, তিনি আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকেন, যাতে করে আত্মীয়-স্বজন ডেকে আনার পর কোনও অপ্রত্যাশিত প্রস্তুতির মুখোমুখি হতে না হয়। আত্মীয়-স্বজন বাদ দিয়ে প্রতিবেশীরাও এই সবে অংশ গ্রহণ করেন। সৌজন্য হিসাবে আয়োজক পরিবারকে উপহার হিসাবে কিছু অর্থ প্রদান করেন।

এই উত্‍সবের সময় প্রচুর মদ্যপান করা হয়। এমনকি যারা কবরে দেহ উত্তোলন করতে যান তাদের হাতেও আফ্রিকান রামের বোতল থাকে। যারা দেহ কাঁধে নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন তারাও আগে মনমতো মদ্যপান করে নেন। মৃতদেহ আবার কবরে শায়াত করার আগে যে ম্যাটটিতে বহন করা হয়েছিল সেটি উত্‍সবে অংশগ্রহণকারী সবাই স্পর্শ করেন। সব শেষে আয়োজকের পরিবার ম্যাটটি নিজের বাড়িতে রেখে দেন এই বিশ্বাসে যে, এটি পরিবারের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে। এই উত্‍সবের সময় পরিবারের প্রধান কর্তা পশুও উত্‍সর্গ করে থাকেন। উত্‍সর্গকিত পশুর মাংস দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করার পাশাপাশি বাড়তি মাংস স্থানীয় দরিদ্র মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৮ শতকের পর থেকে এই প্রথা চালু হয়েছে। তবে একেবারে সঠিক সময়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনও কোথাও। ধারণা করা হয় একটি যুদ্ধের পর নিহত সেনাদের মৃতদেহ দ্বিতীয় বার কবর দেওয়ার ঘটনা থেকেই এই প্রথার প্রচলন ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসনাম যখন খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমন ঘটে, তখন তারা এই প্রথার বিরোধীতা করেছিল বটে। কিন্তু স্থানীয় মানুষ কখনও এই প্রথা পালন থেকে সরে আসেনি।

আফ্রিকার দেশগুলির মৃতদেহ নিয়ে অদ্ভুত সব প্রথা প্রচলন রয়েছে। ইতিহাস ঘাটলেই সে সব দেখা যায়। মিশরীয় বিখ্যাত পিরামিডের প্রতিষ্ঠাতা ফ্যারাওদের কথাই ধরা যাক। পরকালে জীবনে যাতে কোনও কষ্ট না হয়, সেজন্য দাসী ও পোষা প্রাণীগুলোকেও মমি বানিয়ে ফ্যারাওদের মমির সাথে রেখে আসা হত। সেই সাথে দেওয়া হত অসংখ্য দামী জিনিসপত্র। কিন্তু মাদাগাস্কার ফামাদিহানা উত্‍সব ছাড়িয়ে গিয়েছে বাকি সব কিছুকে।পরিবারের সদস্যদের একত্রিত হওয়ার ক্ষেত্রে যখন মৃত সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়, তখন অবাক না হয়ে পারা যায় না। অতিরিক্ত খরচ এবং ক্যাথলিক মিশনগুলো থেকে বিরোধিতা সত্ত্বেও বছরের পর বছর এই প্রথা চলে আসছে শুধু মানুষের বিশ্বাসের ওপর ভর করে।