০৩ মে ২০২৪, শুক্রবার, ০৯:৪৩:১৩ পূর্বাহ্ন


আত্মপ্রেমের নেশা বাড়াচ্ছে নিঃসঙ্গতা !
নৌসিম তাবাস্সুম ঝিলিক:
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৭-২০২৩
আত্মপ্রেমের নেশা বাড়াচ্ছে নিঃসঙ্গতা ! আত্মপ্রেমের নেশা বাড়াচ্ছে নিঃসঙ্গতা !


একা থাকা মানেই একাকীত্বে ভোগা নয়। আবার অনেকের মাঝে থেকেও একাকীত্বে ভোগেন অনেকে। একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা একটা বোধ যা যে কোনও মারণ রোগের থেকে কম ক্ষতিকর নয়। মার্কিন একটি জার্নালে সম্প্রতি বেরিয়েছে যে দিনভর ১৫টা সিগারেট টানার সমান ক্ষতি করে একাকীত্ব। 

বিষয়টা কৌতুকের মনে হলেও সত্যি।  আমেরিকার সার্জেন জেনারেল বিবেক মূর্তি জানিয়েছেন, একাকীত্ব কিন্তু কোনও সমস্যা নয়। এটা একটা বোধ, যা মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে তৈরি করেন। নিজেরাই মনে মনে কষ্ট পান। একাকীত্বের অনেক রকম কারণ আছে। কিন্তু কারণ যাই থাক এর প্রভাবে শরীরের অনেক ক্ষতি হয়। যেমন অতিরিক্ত ধূমপান, ওবেসিটি ক্রনিক ডিজিজের কারণ, তেমনই দীর্ঘদিন একাকীত্বে ভুগলে শরীরের উপর তেমন প্রভাবই পড়ে। সমীক্ষা বলছে, ধূমপানের মতোই স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে একাকীত্ব। সামাজিকভাবে নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিভ্রংশ, স্ট্রোক, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ ও অকালমৃত্যুর শিকার হওয়ার ঝুঁকিও অনেক বেশি। 

এই একাকীত্ব বোধ অনেক রকম হয়। একা থাকা আর একাকীত্ব কিন্তু এক নয়। অনেকেই একা থাকেন কিন্তু জীবনকেও উপভোগ করেন। আর একাকীত্ব হল একটা বোধ, যা মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। গভীর অবসাদ, মানসিক চাপ, হঠাৎ করে পাওয়া কোনও মানসিক আঘাত, ট্রমা, অতীতের কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনার কারণে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভয় বা আতঙ্ক–এই সবই একাকীত্ব বোধের কারণ হতে পারে। দীর্ঘদিন কোনও রোগে ভুগলেও তার থেকে একাকীত্বের ভাবনা আসতে পারে। একাকীত্ব বোধ যদি মনকে আচ্ছন্ন করে তাহলে মানসিক যন্ত্রণা বেশি হয়। নিজের তৈরি করা মানসিক জগতে হারিয়ে গিয়ে নানারকম মনের অসুখের শিকার হতে হয়। আর তার প্রভাব পড়ে শরীরেও। 

বয়সকালে একাকীত্বের বোধ বেশি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানেরা কাজের সূত্রে অন্য শহরে বা দেশে থাকেন। ফলে বাবা-মায়ের দেখাশোনা করার সুযোগ নেই বললেই চলে। বা যাঁরা এক শহরেও আছেন, তাঁরাও সময়ের অভাবে বৃদ্ধ অভিভাবকদের পাশে থাকতে পারেন না বেশিরভাগ সময়েই।

সমীক্ষা বলছে, উন্নত দেশে বেশিরভাগ মানুষ ৭৫-৮০ বছর বাঁচেন। আমাদের দেশে আয়ু আরও বেশি।  যাঁরা বেশি বয়স পর্যন্ত বাঁচেন, তাঁদের একাংশের স্মৃতিভ্রংশ সহ নানা রোগ হয়। যত্নের অভাব, দুশ্চিন্তা, ভয়, টেনশনের কারণে রোগের প্রকোপ আরও বাড়ে। 

মনোবিদরা বলছেন, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডুবে থাকতে গিয়ে মানুষ বাস্তব জীবনে কথা বলতেই ভুলে যাচ্ছে। বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের মধ্যে এই সংক্রমণ প্রবল আকার নিয়েছে। সাইবার-দর্পণেই এখন নিজের মুখ দেখতে ও দেখাতে স্বচ্ছন্দ নবীন প্রজন্ম। আমিত্বের এই অনর্গল উদযাপন সামাজিক নার্সিসিজমের কারণ হয়ে উঠছে। আর এখান থেকেও জন্ম নিচ্ছে একাকীত্ব বা ‘লোনলিনেস’। ভার্চুয়াল পৃথিবী এবং সোশ্যাল মিডিয়াই পরিবার হয়ে উঠছে। তাই ফেসবুকে পরিবার খুঁজছে একাকীত্বে ভোগা মানুষ। কিন্তু মানুষ যখন একা নয়, যখন নিঃসঙ্গ নয়, তখনও তো এড়ানো যাচ্ছে না সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপের অনুপ্রবেশ। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডুবে থাকতে গিয়ে মানুষ বাস্তব জীবনে কথা বলতেই ভুলে যাচ্ছে। 

একাকীত্বের ভাবনা একবার মনে বসে গেলে তার থেকে ক্রমাগত মন খারাপ, মুড সুয়িং ইত্যাদি ব্যাপারগুলো অনেক বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে কমতে আরম্ভ করে শারীরিক শ্রমের পরিমাণও। ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফল খারাপ হতে আরম্ভ করে, অযথা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয় তারা, নেশার খপ্পরেও পড়ে কেউ কেউ। বেড়ে যায় রাগ, মাথাব্যথা, গা-হাত পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। ইনসমনিয়া, শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যাও থাকে কারও কারও ক্ষেত্রে।

একাকীত্ব থেকে বিরক্তিভাব, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। আমরা যে গতিতে ছুটছি আজকাল, জীবনে যা যা অর্জন করতে চাইছি, তার মূলেই লুকিয়ে রয়েছে মনোরোগের বীজ। দীর্ঘদিন একাকীত্বে ভুগলে শরীর, মন দুইয়ের উপরেই প্রভাব পড়বে। এমনকি শরীরে এমন কিছু প্রভাব পড়ে যা কিন্তু সহজে ঠিক হয় না। যেমন স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়। হৃদরোগের সমস্যাও বাড়ে। রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। মনের উপর চাপ এতটাই বাড়ে যে মানুষ খুব দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কখনও কখনও মন খারাপ থাকতেই পারে। একাকীত্ব বোধ হতেই পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন বোধ করলে নিজেকে ইচ্ছাকৃত কষ্ট দেবেন না। লজ্জা কাটিয়ে কারোর সঙ্গে নিজের অনুভূতি শেয়ার করুন। দরকারে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সবসময় চেষ্টা করবেন মন হালকা রাখার। কথা বলুন। দীর্ঘক্ষণ মেসেজ করার বদলে ফোন করতে পারেন, দেখা করতে পারেন। প্রতিদিন কিছু না কিছু ছোটখাটো সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এতে ব্রেন এক্সারসাইজও হয়।