০৬ মে ২০২৪, সোমবার, ০৮:৫৭:৩৪ পূর্বাহ্ন


সিয়াম বা রোযা:
ধর্ম ডেস্ক :
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৩-২০২৪
সিয়াম বা রোযা: সিয়াম বা রোযা:


সিয়াম বা রোযা:

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন :

হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (বাকারাহ : ১৮৩)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

রমযান হলো সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছিল। মানবজাতির জন্য হিদায়াত ও সুস্পষ্ট পথ নির্দেশক এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য নির্ণয়কারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যারাই এ মাস পাবে তারা যেন অবশ্যই সিয়াম পালন করে। (বাকারাহ : ১৮৫)

এ মাস ক্ষমা লাভের মাস। এ মাস পাওয়ার পরও যারা তাদের আমলনামাকে পাপ-পঙ্কিলতা মুক্ত করতে পারল না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ধিক্কার দিয়ে বলেছেন :

‘‘ঐ ব্যক্তির নাক ধূলায় ধুসরিত হোক যার কাছে রমযান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করিয়ে নিতে পারল না।’’ (তিরমিযী : ৩৫৪৫)

সিয়াম পালনকারীকে যেসব পুরস্কার ও প্রতিদান আল্লাহ তা‘আলা দেবেন তার অংশ বিশেষ এখানে উল্লেখ করা হল :

[১] আল্লাহ স্বয়ং নিজে সিয়ামের প্রতিদান দেবেন।

হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

‘‘মানুষের প্রতিটি ভাল কাজ নিজের জন্য হয়ে থাকে, কিন্তু সিয়াম শুধুমাত্র আমার জন্য, অতএব আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। (বুখারী : ১৯০৪)

[২] সিয়াম অতি উত্তম নেক আমল

আবূ হুরাইরাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র একটি হাদীসে তিনি বলেছিলেন :

‘‘হে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাকে একটি অতি উত্তম নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর সমমর্যাদা সম্পন্ন কোন আমল নেই।’’ (নাসাঈ : ২২২২)

অন্যান্য ইবাদত মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু সিয়ামের মধ্যে তা নেই। লোক দেখানোর কোন আলামত সিয়াম পালনে থাকে না। শুধুই আল্লাহকে খুশী করার জন্য তা করা হয়। তাই এ ইবাদতের মধ্যে রয়েছে বিশুদ্ধ ইখলাস।

হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘সিয়াম পালনকারী শুধুমাত্র আমাকে খুশী করার জন্যই পানাহার ও যৌন উপভোগ পরিহার করে।’ (১৮৯৪)

[৩] ক- জান্নাত লাভ সহজ হয়ে যাবে।

সহীহ ইবনু হিববান কিতাবে আছে আবূ উমামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করলেন-

আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যার কারণে আমি জান্নাতে যেতে পারি। তিনি বললেন, তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর সমমর্যাদাসম্পন্ন কোন ইবাদাত নেই। (নাসাঈ : ২২২১)

খ. সিয়াম পালনকারীকে বিনা হিসেবে প্রতিদান দেয়া হয় অন্যান্য ইবাদতের প্রতিদান আল্লাহ তা‘আলা তার দয়ার বদৌলতে ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু সিয়ামের প্রতিদান ও তার সাওয়াব এর চেয়েও বেহিসেবী সংখ্যা দিয়ে গুণ দিয়ে বাড়িয়ে দেয়া হবে। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, ‘‘মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, কিন্তু সিয়ামের বিষয়টি ভিন্ন। কেননা সিয়াম শুধুমাত্র আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব। (মুসলিম : ১১৫১)

অর্থাৎ কি পরিমাণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করে এর প্রতিদান বাড়িয়ে দেয়া হবে এর কোন হিসাব নেই, শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন সিয়ামের পুণ্যের ভান্ডার কত সুবিশাল হবে।

[৪] জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সিয়াম ঢাল স্বরূপ

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

‘‘সিয়াম ঢাল স্বরূপ। এ দ্বারা বান্দা তার নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করতে পার।’’ (আহমাদ : ১৫২৯৯)

[৫] জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য সিয়াম একটি মজবুত দূর্গ

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

‘‘সিয়াম ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার এক মজবুত দূর্গ।’’ (আহমাদ : ৯২২৫)

[৬] আল্লাহর পথে সিয়াম পালনকারীকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে দূরে রাখেন।

এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

(ক) ‘‘যে কেউ আল্লাহর রাস্তায় (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য) একদিন সিয়াম পালন করবে, তদ্বারা আল্লাহ তাকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে সত্তর বছরের রাস্তা পরিমাণ দূরবর্তীস্থানে রাখবেন। (বুখারী : ২৮৪০; মুসলিম : ১১৫৩)

(খ) ‘‘যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর পথে সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তার কাছ থেকে জাহান্নামকে সত্তর বছরের রাস্তা দূরে সরিয়ে নেবেন। (মুসলিম : ১১৫৩)

[৭] ইফতারের সময় বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন।

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

ইফতারের মূহূর্তে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রমাযানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে। (আহমাদ : ৫/২৫৬)

[৮] সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশ্কের চেয়েও উত্তম (সুগন্ধিতে পরিণত হয়)।

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

যার হাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জীবন সে সত্তার শপথ করে বলছি, সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ তা‘আলার কাছে মিশকের ঘ্রাণের চেয়েও প্রিয় হয়ে যায়। (বুখারী : ১৯০৪; মুসলিম : ১১৫১)

[৯] সিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি বিশেষ আনন্দ মুহূর্ত।

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

সিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টো বিশেষ আনন্দ মুহূর্ত রয়েছে : একটি হল ইফতারের সময়, আর দ্বিতীয়টি হল তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময়। (বুখারী : ৭৪৯২; মুসলিম : ১১৫১)


[১০] সিয়াম কিয়ামাতের দিন সুপারিশ করবে

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

সিয়াম ও কুরআন কিয়ামাতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে আমার রব, আমি দিনের বেলায় তাকে (এ সিয়াম পালনকারীকে) পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর।

অনুরূপভাবে কুরআন বলবে, হে আমার রব, আমাকে অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবূল করা হবে। (আহমাদ : ২/১৭৪)

[১১] সিয়াম হল গুনাহের কাফফারা

(ক) আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয়ই নেক আমল পাপরাশি দূর করে দেয়। (সূরা হুদ : ১১৪)

(খ) রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

পরিবার পরিজন, ধন-সম্পদ ও প্রতিবেশিদের নিয়ে জীবন চলার পথে যেসব গুনাহ মানুষের হয়ে যায় সালাত, সিয়াম ও দান খয়রাত সেসব গুনাহ মুছে ফেলে দেয়। (বুখারী : ৫২৫; মুসলিম : ১৪৪)

[১২] সিয়াম পালনকারীর এক রমযান থেকে পরবর্তী রমাযানের মধ্যবর্তী সময়ে হয়ে যাওয়া ছগীরা গুনাহগুলোকে মাফ করে দেয়া হয়।

ক- আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘তোমরা যদি নিষিদ্ধ কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাক তাহলে তোমাদের ছগীরা গুনাহগুলোকে মুছে দেব এবং (জান্নাতে) তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব। (সূরা নিসা : ৩১)

খ- রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এর মধ্যবর্তী সময় ও এক জুমুআ থেকে অপর জুমুআ এবং এক রমযান থেকে অপর রমযান পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে হয়ে যাওয়া ছগীরা গুনাহগুলোকে (উল্লেখিত ইবাদতের) কাফ্ফারাস্বরূপ মুছে দেয়া হয় সে যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। (মুসলিম : ২৩৩)

[১৩] সিয়াম পালনকারীর পূর্বেকার গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন : 

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমযানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারী : ৩৮; মুসলিম : ৭৬৯)

[১৪] সিয়াম যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখে

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী। আর যে ব্যক্তি বিবাহের সামর্থ রাখেনা সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার জন্য নিবৃতকারী। (অর্থাৎ সিয়াম পালন যৌন প্রবৃত্তি নিবৃত করে রাখে) (বুখারী : ১৯০৫; মুসলিম : ১৪০০)

[১৫] সিয়াম পালনকারীরা রাইয়ান নামক মহিমান্বিত এক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :

জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। যার নাম রাইয়্যান। কিয়ামতের দিন শুধু সিয়ামপালনকারীরা ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিন ঘোষণা করা হবে, সিয়াম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবে ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য। তারা প্রবেশ করার পর ঐ দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হবে। ফলে তারা ব্যতীত অন্য কেউ আর সেই দরজা দিয়ে জান্নাতে ঢুকতে পারবেনা। (বুখারী : ১৮৯৬; মুসলিম : ১১৫২)

রোযার দুটি রুকন:

১। ফজর উদয় হওয়ার পর থেকে নিয়ে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সময় ধরে যাবতীয় রোযা নষ্টকারী জিনিস থেকে বিরত থাকা। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না কালো সুতা থেকে ফজরের সাদা সুতা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে। অতঃপর তোমরা রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর। (বাকারা ২/১৮৭) 

২। নিয়ত ; আর তা হল, মহান আল্লাহর আদেশ পালন করার উদ্দেশ্যে রোযা রাখার জন্য হৃদয়ের সংকল্প। 

সুতরাং যে ব্যক্তি ফরয (যেমন রমাযান, কাযা, নযর অথবা কাফ্ফারার) রোযা রাখবে, সে ব্যক্তির জন্য নিয়ত ও সংকল্প করা ওয়াজেব। আর নিয়ত হল, হৃদয়ের কাজ; তার সাথে মুখের কোন সম্পর্ক নেই। তার প্রকৃতত্ব হল, মহান আল্লাহর আদেশ পালন এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করার উদ্দেশ্যে কোন কাজের সংকল্প করা। বলা বাহুল্য, ‘নাওয়াইতু আন আসূমা গাদাম মিন শাহরি রামাযান’ বলে নিয়ত পড়া বিদআত।

লেখক-

প্রফেসর ড. মো. মাসুদুল হাসান খান (মুক্তা)

বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।