২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ও ১ নভেম্বর রাজশাহী এসেছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই সময় দুই বারই রাজশাহী এসে পদ্মাপাড়ে মিনা বেগমের হাতের কালাইরুটি খেয়েছিলেন তিনি। সুস্বাদু কালাইরুটি পচ্ছন্দ হওয়ায় সেতুমন্ত্রী ২০০০ হাজার টাকা বখশিসও দেন মিনা বেগমকে।
তবে মিনা বেগম সেসময় বখশিসের অর্থ না গ্রহণ করে চেয়েছিলেন ছেলের জন্য স্থায়ী চাকরি। তার (মিনা বেগম) কথা মতো প্রতিশ্রুতিও প্রদান করেন ওবায়দুল কাদের। পরে মুঠোফোনে তৎকালীন রাজশাহীর জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা প্রদান করেন মিনা বেগমের চাকরি দেওয়ার। পরবর্তী সময়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের ৮ জনের মতো নিম্নপদে জনবল নিয়োগ হলেও চাকরি জুটেনি মিনা বেগমের ছেলের।
তবে হাল ছাড়েননি মিনা বেগম। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দেওয়া প্রতিশ্রুতির আশায় আজো দিন গুনছেন তিনি। সেতুমন্ত্রী আবার রাজশাহী আসলে তাকে জানাবেন তার আবদারের কথা। এ আশায় আজো ওবায়দুল কাদেরের সাথে দাড়িয়ে তোলা কয়েকটি নিজের ছবি আজো রেখেছেন স্বযত্নে। তবে সেতুমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ছেলের চাকরি না পাওয়ার বেদনাটি জানাতে পারেনি তিনি।
রাজশাহী নগরীর শ্রীরামপুরের বাসিন্দা মিনা বেগম (৫২)। প্রায় ৩০ বছর ধরে শহররক্ষা বাঁধের উপর কালাইরুটির দোকান চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ঘরে রয়েছেন অসুস্থ স্বামী হাসিবুর রহমান (৬৫)। সংসারে চার ছেলে রুবেল, রানা, ওলি ও মিঠুন। বড় ও ছোট ছেলে বাসের ড্রাইভার এবং সেজো ছেলে ইলেকট্রিশিয়ান। তবে বেকার রয়েছেন মেজো ছেলে। তাকে নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন মিনা বেগম।
দু’পাচ বছর পূর্বেও বেচাবিক্রি হতো হাজার চারেকের মতো। বেচাকেনা শেষে টিকতো সাত থেকে আট শতটাকা। মাঝে করোনায় প্রায় এক বছর বন্ধ ছিল দোকান। তাই আয়-রোজগারও তেমন হয়নি। ইদানীং বেচা-বিক্রি হলেও হাতে থাকে চার থেকে পাচশত টাকা। তাতেই বিছানাগত অসুস্থ স্বামী ও বেকার পড়ে থাকা ছেলেকে নিয়ে চালান সংসার।
নিরিবিলি পরিবেশ, আসল কালাইয়ের আটা দিয়ে রুটি এবং পরিপাটি করে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে কালাইরুটি পরিবেশনের জন্য মিনা বেগমের রুয়েছে সুনাম। রিক্সাচালক থেকে শুরু করে কোটিপতি এমনকি সরকারি কর্তাব্যক্তিরাও আসেন তার দোকানে। পদ্মাপাড়ে বসে মনোরম পরিবেশে সুস্বাদু কালাইরুটি ও বেগুন ভর্তার স্বাদ আস্বাদন করেন অনেকেই।
প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিক্রি করেন কালাইরুটি। প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও (১ নভেম্বর, ২০১৭) সকাল সাড়ে ছটার দিকে দোকান বিছিয়ে কেবলই বসেছিলেন কালাইরুটি বিক্রেতা মিনা বেগম। এরই মধ্যে হঠাৎ দোকানে আসেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
মিনা বেগম বলেন, ২০১৭ সালের দিকে ওবায়দুল কাদের এসেছিলেন। আমার হাতের কালাইরুটি খেয়েছেন। খেয়ে খুব ভালো লাগাই তিনি বলেছিলেন, রাজশাহী আসলে আবার আমার (মিনা) দোকানে কালাইরুটি খাবেন। তার কয়েকমাস পর আবার তিনি রাজশাহী আসেন। সকাল বেলা আমার দোকানে এসে তিনি কালাইরুটি ও বেগন ভর্তা খান।
তিনি বলেন, খুশি হয়ে তিনি আমাকে ২০০০ টাকা বখশিসও দিচ্ছিলেন। কিন্তু আমি সেটা না নিয়ে আমার মেজো ছেলের চাকরি-বাকরির জন্য বলেছিলাম। পরে তিনি আমাকে বখশিস দিয়ে বলেছিলেন- তোমার ছেলের চাকরির ব্যবস্থা করে দিবো। ডিসি সাহেবকে তিনি বলেও দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ ভালো জানে ক্যান যে ছেলেটার চাকরি-বাকরি হলো না।
‘এরপর মন্ত্রী সাহেবের সাথে যোগাযোগও করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো ভাবেই আর যোগাযোগ করতে পারিনি। তবে মন্ত্রী বলেছিলেন, রাজশাহী যতবার আসবেন আমার হাতের কালাইরুটি তিনি খাবেন। তাই তার যেনো মনে থাকে সেকারণে তার সাথে তোলা ছবি আমি আজো খুব যত্ন করে নিজের কাছে রেখেছি। তিনি আসলেই তাকে বলবো- আমার ছেলের যেনো একটা গতি করে দেন মন্ত্রী সাহেব বলে মন্তব্য করেন তিনি।’
একহাতেই জ¦লন্ত চুলোর কড়াই দিচ্ছেন রুটিকালাইরুটি। আবার বানাচ্ছেন আরেকটি। এরই মধ্যে কাস্টোমারের চাহিদা মতো দিচ্ছে বেগুন ভর্তা-পানি-লবন কিংবা ঝাল।
কাজের ব্যস্ততার মাঝেই মিনা বেগম প্রতিবেদককে জানান, আমার কাছে শুধু ওবায়দুল কাদেরই কালাইরুটি খাননি। শাহারা খাতুন (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), নাসিম (প্রয়াত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী), রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, কামাল হোসেন (বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) সহ অনেক বড় বড় মানুষ কালাইরুটি খেয়ে গেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ছেলেটা বেকারই পড়ে আছে।
মিনা বেগমের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় কালাইরুটি খাচ্ছিলেন ঝিনাইদহের বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। আরআরএফ নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘শুনছি বড় বড় মন্ত্রী-মিনিস্টার খালা (মিনা) কালাইরুটি খেয়ে গেছেন। আমারও খেয়ে খুব ভালোই লাগছে।’
তিনি বলেন, ‘খালার ছেলের চাকরি না পাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে হয়তোবা তার উপকার হবে। তার ছেলে সেতুমন্ত্রীর দ্বারা একটি চাকরি পাক। খালার স্বপ্ন পূরণ হোক এটাই কাম্য।’
রাজশাহীর শিরোইল কলোনির বাসিন্দা ইফতে খায়ের আলম। মিনা বেগমের কালাইরুটির নিয়মিত ক্রেতা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খালা (মিনা) খুব ভালো কালাইরুটি বানায়। ওবায়দুল কাদের সহ অনেকেই এখানে এসে কালাইরুটি খেয়েছেন তার হাতে। কিন্তু ভাইরাল হয়েও ভাগ্য ফেরেনি খালার।’
প্রতিবেদককে তিনি জানান, ‘তার ছেলের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। শুনেছি চেষ্টাও করেছিলেন মন্ত্রীর সাথে দেখা করার। কিন্তু পারেননি। তাই তিনি এব্যাপারে আর কাউকে বলেন না। আশায় আছেন, মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আসলে তার ছেলের বিষয়টি জানাবেন তিনি।’
রাজশাহীর সময় / এফ কে