বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি বলেছে তারা ক্ষমতায় গেলে কোন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দলীয় বিবেচনায় কিংবা আক্রোশমূলক কোন ব্যবস্থা নেবে না এবং কাউকে নিতেও দেবে না।
দলের এক বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যেসব কর্মকর্তা কর্মচারীরা কর্তৃপক্ষের চাপে বা আদেশে বেআইনি কাজ করেছেন তারা 'এখন থেকে এ ধরণের কাজ না করলে’ তাদের ভূমিকাও সহানুভূতির সাথে দেখবে দলটি।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিবৃতিটি দিয়েছেন যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে।
এ বিবৃতিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতি কোন প্রচ্ছন্ন হুমকি কিনা - এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, প্রশাসনকে সচেতন করাই তাদের লক্ষ্য।
এই নেতারা বলছেন, প্রশাসনে কাজ করা কর্মকর্তাদের তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি অতীতে যে যাই করুক - এখন থেকে নিরপেক্ষ আচরণ করলে তাদের চাকুরীর সুরক্ষা বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও থাকবে - এমন বার্তাই দেয়া হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে।
একই সাথে এর উদ্দেশ্য হলো, প্রশাসনের কোনো স্তরেই যেন বিএনপিকে নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘অমূলক’ কোনো ভয় না থাকে. এবং একই সাথে সামনের দিনগুলোতেও যেন কর্মকর্তারা নিরপেক্ষ থাকতে উৎসাহী হন - বলছেন তারা।
বিএনপির বিবৃতিটি এমন সময় এলো যখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিসহ পশ্চিমাদের নানা তৎপরতায় সরকার কিছুটা চাপে আছে বলে অনেকে মনে করেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বরাবরই এ ধরণের চাপের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমাদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাইছে না।
কিন্তু বাংলাদেশে গত পনের বছরে সরকার তার মতো করে দলীয় সমর্থক কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রশাসন সাজিয়ে রেখেছে বলে বিরোধীরা বরাবরই অভিযোগ করে আসছে। এর আগে বিএনপি আমলেও তখনকার সরকারি দলের বিরুদ্ধে একই ধরণের অভিযোগ ছিলো সে সময়ের বিরোধী দলের।
নির্বাচনের আগে সরকারি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে এমন বিবৃতিও নতুন নয়। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরণের বিবৃতি কি জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলে ?
এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলছেন পেশাদার কর্মকর্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের কাজের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দলগুলোর দিক থেকে আসাটা ইতিবাচক।
“কিছু কর্মকর্তা সবসময় সরকারি দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তাদের ওপর হয়তো এর প্রভাব পড়েনা। তবে কিছু পেশাদার কর্মকর্তা দোলাচলে থাকেন যে সরকার পরিবর্তন হলে তাদের কি হবে – এ ধরণের কর্মকর্তারা আশ্বস্ত হতে পারেন এমন ঘোষণা থেকে,” বলছিলেন মি. মজুমদার।
পঁচিশে জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন জনগণের সমর্থনে যদি বিএনপি দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়, তাহলে প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকুরীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
“কোন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দলীয় বিবেচনায় কিংবা আক্রোশমূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না বা কাউকেই তা করতে দেওয়া হবে না।"
"উপরন্তু, বিগত পনের বছর যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান, দীর্ঘদিন ওএসডি রাখা এবং পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে, তাদের প্রতিও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে”।
এতে আরও বলা হয়েছে যে যারা কর্তৃপক্ষের বেআইনি আদেশে কিংবা চাপে পড়ে বিতর্কিত কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন - ‘এখন থেকে তারা যদি আর এরূপ অন্যায়, অবৈধ ও বেআইনি কোন কাজ না করেন, তাহলে তাঁদের পূর্ববর্তী ভূমিকা সহানুভূতি ও ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হবে’।
এবারের বিবৃতিতে যাই থাকুক না কেন, বিএনপি বরাবরই সরকারের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে দলীয়করণের অভিযোগ করে আসছে। এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘পুলিশ ও জনপ্রশাসনের’ কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে করা হয়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেছিলো।
সরকার এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও পুলিশ ও জনপ্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে গণমাধ্যমেও।
২০২১ সালে শরিয়তপুরে একজন ওসি রাজনৈতিক শ্লোগান দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় এসেছিলেন। সম্প্রতি নিজ এলাকায় রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে পরে ওএসডি হয়েছেন সরকারের একজন সিনিয়র সচিব। পুলিশের কিছু কর্মকর্তার নাম ধরেই সমালোচনা হয় বিএনপির সভা সমাবেশ থেকে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন, প্রশাসনের মধ্যে থাকা কিছু লোকজন বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। এটা বন্ধ করার পাশাপাশি বিএনপি আশ্বস্ত করতে চাইছে যে তারা ক্ষমতায় গেলে কোনো পেশাদার কর্মকর্তা প্রতিহিংসার শিকার হবে না।
“আমাদের তো প্রশাসনের সাথে যুদ্ধ নেই। আওয়ামী লীগ উগ্র দলীয়করণ করেছে বলে পুলিশের কেউ কেউ দলীয় শ্লোগান দেন। আবার সচিবদের কেউ কেউ এলাকায় দলীয় বক্তব্য দেন। এগুলো বন্ধ করে কর্মকর্তারা নিরপেক্ষ যাতে হতে পারেন- সেই বার্তাই আমরা দেয়ার চেষ্টা করেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে দলের একাধিক নেতা বলছেন ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতা ধরে রেখেছে বলে তারা মনে করেন।
এবার তাই আগে থেকেই প্রশাসনযন্ত্রের দিকে নজর দিয়েছে বিএনপি। গত মাসের শুরুতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গুম, খুন এবং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট ওসি, এসপিসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিষয়ে তথ্য জানতে চেয়ে সারা দেশে চিঠি পাঠিয়েছিলো দলটি।
চিঠিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সাথে জড়িত, বাদী, তদন্তকারী বা তদারককারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নাম ও পরিচয় জানাতে বলা হয়। যদিও পরে দলটি সে অবস্থান থেকে সরে যায়।
দলটির মিডিয়ার সেলের প্রধান জহিরউদ্দিন স্বপন বলছেন, বিএনপি স্পষ্ট করে মনে করিয়ে দিয়েছে যে ‘গুটিকয়েক দলবাজের’ কারণে গোটা প্রশাসনের সাথে বিএনপির কোন বিরোধ নেই।
“আমরা মনে করি বেশীরভাগ কর্মকর্তাই পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করতে চান। যদিও ক্ষুদ্র একটি অংশের কারণে সেটি ব্যাহত হয়েছে। তাই বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী হবে সেটা নিয়ে যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না থাকে সেটাই বিএনপি পরিষ্কার করেছে,” - বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
দলের আরেকটি সূত্র বলছে যে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ নানা বিদেশী গোষ্ঠীর নির্বাচন কেন্দ্রিক তৎপরতা বেড়েছে।
আবার যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় হিসেবে যারা কাজ করবেন তাদের প্রতি সতর্কবার্তা আছে।
আবার বিদেশী কূটনীতিকরা যারা আসছেন তাদের কাছে বিএনপি প্রশাসন দলীয়করণের অভিযোগ তুলছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব কূটনীতিকরা বিএনপির কাছেও জানতে চাইছে যে নির্বাচনে জিতে তারা ক্ষমতায় গেলে কী করবেন।
এসব বিবেচনা করে বিএনপি ইতোমধ্যে একটি রূপরেখাও ঘোষণা করেছে যে নির্বাচনে বিজয়ী হলে তারা কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
এর ধারাবাহিকতাতেই মূলত প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের লক্ষ্য করে বিবৃতিটি দিয়েছে বিএনপি।
দলটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন অসীম বলছেন, সরকারের অপপ্রচারের কারণে অনেক কর্মকর্তার মধ্যে হয়তো ভয় ভীতি কাজ করতে পারে যে বিএনপি প্রতিশোধ নেবে।
“সেজন্যই বিএনপি নিশ্চিত করেছে যে এমন কিছু ঘটবে না। আমরা জানি প্রশাসন দলীয়করণ হয়ে আছে। কিন্তু আমরা চাই কর্মকর্তারা আইন মেনে কাজ করবেন এবং বেআইনি কোনো আদেশ যেন তারা না শোনেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে অনেক কর্মকর্তাকে সরকার দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে কিন্তু বিএনপি বলতে চাইছে যে অতীতে যাই হোক এখন থেকে যেন তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর মতো দায়িত্ব পালন করেন।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের এ ধরণের বার্তা সুষ্ঠু নির্বাচনে কর্মকর্তাদের আগ্রহী করে তুলবে এবং একই সাথে প্রশাসন নিয়ে বিএনপির পরিকল্পনা সম্পর্কেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা একটি ধারণা পাবেন। সুত্র: বিবিসি।