‘আমার কাছে এখনো পড়ে আছে তোমার প্রিয় হারিয়ে-যাওয়া চাবি কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো?’
সেই চাবির গোছা, প্রেমিকের সঙ্গে পালানোর সময়ে যা ভুল করে চলে এসেছিল মেয়েটির পোঁটলায়, এক যুগেও তাতে জং ধরল না।
এর মধ্যে কত শীত, বসন্ত গেল। রুক্ষ হাওয়ায় শুকিয়ে গেল মেয়েটি। চৈতালি ঝড়ে আবার সেজে উঠল। একে একে বাধা পার হয়ে, ভোটে জিতে সে এলাকার অধীশ্বর হল। তবু সেই চাবি তার ফেরানো হল না।
চাবির কথা থাক। বরং এস হুসেন জ়াইদির লেখা ‘মাফিয়া কুইনস অব মুম্বই’ বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের পাতা ওল্টানো যাক। ‘দ্য ম্যাট্রিয়ার্ক অব কামাথিপুরা’। কামাথিপুরার মাতৃতন্ত্রের গল্প। স্বাধীনতার পরপর, পঞ্চাশ-ষাট দশকের মুম্বই। তার যৌনপল্লি কামাথিপুরা। কলকাতার সোনাগাছির মতোই তার ঐতিহ্য। সেখানকার একটি মেয়ে কী ভাবে সাধারণ যৌনকর্মী থেকে এলাকার শেষ কথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কী ভাবে পৌঁছেছিল প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর দরবারে, এ তারই গল্প।
সেই গল্পই অধ্যায়ের প্রথম পাতা থেকে তুলে আনলেন সঞ্জয় লীলা ভন্সালী। তাঁর ‘গঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি’ ছবিতে। আড়াই ঘণ্টার সেই ছবি কখনও বইয়ের পাতায় ঢুকল, কখনও সেখান থেকে বেরিয়ে আরও বাড়তি কাহিনি তুলে ধরল সেলুলয়েডে। এবং পুরো সময়টায় একজনের দিকেই মূলত তাক করা রইল ক্যামেরার লেন্স। আলিয়া ভট্ট।
বড় সাধ ছিল মেয়েটির, হিন্দি ফিল্মে হিরোইন হবে। প্রেমিকের হাত ধরে চলল বম্বে (অধুনা মুম্বই)। বাড়ি থেকে পালানোর পরেই সে তার পোঁটলাপুঁটলির মধ্যে আবিষ্কার করে বাড়ির চাবিটা। বাবা কী ভাবে নবরাত্রিতে পোশাক বার করবে আলমারি খুলে, সেই চিন্তায় যখন মেয়েটি বিভ্রান্ত, তার চোখে ফিল্মি দুনিয়ার কাজল লাগিয়ে দিল প্রেমিক।
তার পরের গল্প পরিচিত। মেয়েটিকে এনে কামাথিপুরায় বিক্রি করে দেয় সেই যুবক। এ মেয়েকে দমিয়ে রাখা কঠিন, প্রথম রাতেই বুঝে যায় সেই বাড়ির মালকিন বা মাসি (সীমা পহওয়া)। আর সেই রাতেই কাথিয়াওয়াড়ের গঙ্গা বদলে যায় গঙ্গুতে।
গঙ্গুর পরিচয় হয় বম্বের তখনকার মাফিয়া ডন করিম লালার সঙ্গে। করিমের বোন হিসাবেই এর পর তার উত্থান। কোঠার মাসি মারা গেলে সেখানকার দায়িত্ব নেয় সে। রাজ়িয়াবাইকে হারিয়ে এলাকার প্রতিনিধি হয় গঙ্গু। যৌনপল্লিকে বাঁচানোর লড়াই তাকে নিয়ে যায় আজ়াদ ময়দানে। সেখানে তার দেওয়া বক্তৃতা জনপ্রিয় হয়ে যায় রাতারাতি। এই লড়াই গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর দরবার পর্যন্ত।
বই পড়ে একটাই প্রশ্ন মনে হয়েছিল— আধুনিক ভারতে যৌনকর্মীদের মধ্যে প্রথম দিককার এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে কেন মাফিয়া বলা হবে? মেয়েটি করিম লালার সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের বিদ্রোহী সত্তাকে তুলে ধরেছিল বলে? সিনেমায় তাই মাফিয়া শব্দের ধারেকাছে যাননি ভন্সালী। কিন্তু তিনি তৈরি করে দিয়েছেন আরও কয়েকটি ভুরু কোঁচকানো মুহূর্ত। যেমন?
ছবি দেখতে বসে বারবার মনে হয়েছে, যত প্রাচুর্য রয়েছে সেট তৈরিতে, ততটা কি খুব প্রয়োজন ছিল? যেখানে কাহিনি বইয়ের গল্পে ঢুকেছে, চিত্রনাট্য শুকিয়ে গিয়েছে কাঠের মতো। বরং সেখান থেকে বেরিয়ে ফিকশনে যেতেই তাতে রস এসেছে।
সঞ্জয় তাঁর ‘দেবদাস’-এ গল্প বদলেছিলেন, রোশনাই আর নাচগান এমন ভাবে মিশিয়েছিলেন যাতে তা উপচে পড়লেও দর্শকের একঘেয়ে লাগেনি। ‘পদ্মাবত’-এও তাই। কিন্তু গঙ্গুবাইয়ের মতো বাস্তব চরিত্রকে নিয়ে ছবি করতে গিয়ে এই ভারসাম্যেরই অভাব ঘটেছে। সুর কেটেছে কোথাও কোথাও।
সেই সুরকে যদি কোনও এক জন ধরে রাখার চেষ্টা করে থাকেন, তিনি আলিয়া ভট্ট (গঙ্গুবাই)। মধ্যমণি তিনিই টেনে নিয়ে যান ছবিটিকে। বলিউডের ‘বেবি ফেসড’ নায়িকা প্রত্যয়ী শরীরী ভাষায় হয়ে উঠেছেন ‘কোঠেওয়ালি’। নিজেকে চুরমার করে ভাঙার আরও একটি পরীক্ষায় সসম্মান উত্তীর্ণ আলিয়া। তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন অজয় দেবগণ (করিম লালা), বিজয় রাজ (রাজ়িয়াবাই), ইন্দিরা তিওয়ারি (কমলি) প্রমুখ। বহু দিন পরে হিন্দি ছবিতে শোনা গেল কাওয়ালি। শ্রেয়া ঘোষাল, অরিজিৎ সিংহের কণ্ঠে রয়েছে মানানসই গান।
সব শেষে চাবির কথা। ভুল করে নিয়ে আসা গেরস্থালির সেই চাবিগোছা হাতে নিয়ে এক যুগ পরে ট্রাঙ্কলে বাড়িতে কথা শুরু করল গঙ্গু। কিন্তু সে সব কথা মা কানেই তুললেন না। সে চাবি আর কেউ ফেরত চাইল না।
সে দৃশ্য ছবিতে কেউ মনে রাখবে না। কারণ, জয়ী গঙ্গুকে দেখাতে গিয়ে পরাজিত গঙ্গু হারিয়ে গেল কাহিনির মধ্যেই।