২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০৮:২৮:৪৯ অপরাহ্ন


কোরআনের আলোকে কোরবানি
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৬-২০২২
কোরআনের আলোকে কোরবানি ফাইল ফটো


ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও বিশেষ ইবাদত কোরবানি। হজরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে কোরবানি বিদ্যমান ছিল। যুগে যুগে সব নবি-রাসুলের আমলে কোরবানি চালু থাকলেও এর পদ্ধতি এক রকম ছিল না। সুরা মায়েদাযর ২৭-৩১ আয়াতে হজরত আদম আলাইহিস সালামের দুই সন্তানের কোরবানির এক রকম পদ্ধতির কথা ওঠে এসেছে। আবার ইসলামি শরিয়তে কোরবানির যে পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে, তা ‘মিল্লাতে ইবরাহিমি’তে বিদ্যমান ছিল। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। এ কারণেই কোরবানি ‘সুন্নাতে ইবরাহিমি’ নামে সমধিক পরিচিতি।

কোরবানির বিধান সব নবি-রাসুলদের শরিয়তেই ছিল। কোরআনের বর্ণনা থেকেই এ বিধানের প্রমাণ পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ لِکُلِّ اُمَّۃٍ جَعَلۡنَا مَنۡسَکًا لِّیَذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰهِ عَلٰی مَا رَزَقَهُمۡ مِّنۡۢ بَهِیۡمَۃِ الۡاَنۡعَامِ ؕ فَاِلٰـهُکُمۡ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ فَلَهٗۤ اَسۡلِمُوۡا ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُخۡبِتِیۡنَ

‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)

আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম এ কোরবানি। কোরবানি শব্দ থেকেই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আরবি ‘করব বা কোরবান’ (قرب বা قربان) শব্দ দুটি মুসলমানদের মাঝে বেশি ব্যবহৃত। ফার্সি ও উর্দু ভাষাতে (قربانى) কোরবানিতে রূপান্তরিত হয়। এর অর্থ হলো- নিকটবর্তী, নৈকট্য বা সান্নিধ্য। তাই আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য শরিয়তসম্মত পন্থায় বান্দা যে আমল করে তাকে আভিধানিক দিক থেকে তাকে ‘কোরবান’ বলা যেতে পারে। তবে শরিয়তের পরিভাষায় ‘কোরবান’ শব্দের মর্ম তা-ই যা উপরে উল্লেখিত হয়েছে।

দুনিয়ার প্রথম কোরবানি: আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দা যাচাই-বাচাইয়ে ‘কোরবানি’কে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যেমনিভাবে তিনি হজরত আদম আলাইহিস সালামের সময় তার দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাঝে কোরবানির বিধান দিয়েছিলেন। যা ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম কোরবানি। যেখানে আল্লাহ তাআলা হাবিলের কোরবানিকে গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ اتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ ۘ اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِهِمَا وَ لَمۡ یُتَقَبَّلۡ مِنَ الۡاٰخَرِ ؕ قَالَ لَاَقۡتُلَنَّکَ ؕ قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰهُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ

‘হে রাসুল! আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হল এবং অন্যজনের কোরবানি কবুল হল না। সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ২৭)

لَئِنۡۢ بَسَطۡتَّ اِلَیَّ یَدَکَ لِتَقۡتُلَنِیۡ مَاۤ اَنَا بِبَاسِطٍ یَّدِیَ اِلَیۡکَ لِاَقۡتُلَکَ ۚ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اللّٰهَ رَبَّ الۡعٰلَمِیۡنَ

সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হাত বাড়াবো না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ২৮)

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কোরবানি

মানুষের মনের সর্বোচ্চ ত্যাগই হলো কোরবানি। কোরবানির পশুর রক্ত, পশম, হাড় কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে পৌছে না। আল্লাহ তাআলা মানুষের মনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। যার দৃষ্টান্ত হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। তিনি ‘কোরবানি’র নির্দেশকে হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করেছিলেন বলেই তা বাস্তবে সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর কোরবানি কবুল করেছিলেন। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ বলেন-

لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِن يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ

এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৭)

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রার্থনা

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ

‘হে আমার প্রভু! আমাকে এক সৎ ছেলে সন্তান দান করুন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০০)

সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ

فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ

‘সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০১)

আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে সহনশীল হিসেবে উল্লেখ করেন। সত্যিই হজরত ইসমাইল ছিলেন সহনশীল। কেননা তিনি তার কথা ও কাজে আল্লাহর দেওয়া বিশেষণে নিজেকে রাঙিয়ে ছিলেন। সে ঘটনাও উঠে এসেছে কোরআনে।

কোরবানির নির্দেশ ও বাস্তবায়নের ঘটনার বর্ণনা

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ

‘অতপর যখন সে পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহিম তাকে বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কি? সে (ইসমাইল) বলল, হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে সবরকারী (সহনশীল) পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০২)

فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ

‘যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইবরাহিম তাকে জবেহ করার জন্যে শায়িত করলো।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৩)

وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ

‘তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম!’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৪)

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম স্বপ্নে কোরবানির নির্দেশ পেয়ে যখন বাস্তবায়ন করলেন তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ

‘তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৫)

আল্লাহ তাআলা কর্তৃক কোরবানির এ নির্দেশ ছিল হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জন্য তাঁর নৈকট্য অর্জনের এক মহাপরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاء الْمُبِينُ

‘নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৬)

কোরবানির পশু মহান আল্লাহর অপূর্ব দান। হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের পরিবর্তে তিনি জবেহের জন্য তাৎক্ষনিক এক জন্তু পাঠিয়ে তা জবেহ করার ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ

‘আমি তার (ইসমাইল আলাইহিস সালামের) পরিবর্তে দিলাম জবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৭)

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রতি শান্তি

কোরবানির ঘটনায় উত্তীর্ণ হওয়ায় হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রতি শান্তির ঘোষণা দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ - سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ - كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ

‘আমি তার জন্যে এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে, ইবরাহিমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৮-১১০)

ইসলামি শরিয়তে কোরবানি

ইসলামি শরিয়তের আলোকে পারিভাষিকভাবে দুই ধরনের কোরবানি রয়েছে। তাহলো-

১. হজ মৌসুমের কোরবানি: হজ ও ওমরাহ পালনকারীরা জামরায় পাথর নিক্ষেপ করে পবিত্র নগরী মক্কার মিনা প্রান্তরের নির্ধারিত স্থানে যে কোরবানি আদায় করে থাকেন। এর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। যথা-‘কিরান’ বা তামাত্তু হজ আদায়কারীর ওয়াজিব কোরবানি। ইফরাদ হজকারীর নফল কোরবানি। হজ-ওমরাহ পালনকারীদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা ‘হাদি’(কোরবানির পশু) দ্বারা কোরবানি। হজ আদায়ে অক্ষম হওয়ার কারণে বা কোনো নিষিদ্ধ কর্মের জরিমানারূপে (কাফফারা) অপরিহার্য কোরবানি, মানতের কোরবানি কিংবা দশ জিলহজের সাধারণ কোরবানি।

এ কোরবানির বিধান মৌলিকভাবে সুরা হজ, সুরা বাকারা, সুরা মায়েদা ও সুরা ফাতহ’তে এসেছে এভাবে-

وَ اَذِّنۡ فِی النَّاسِ بِالۡحَجِّ یَاۡتُوۡکَ رِجَالًا وَّ عَلٰی کُلِّ ضَامِرٍ یَّاۡتِیۡنَ مِنۡ کُلِّ فَجٍّ عَمِیۡقٍ ﴿ۙ۲۷﴾  لِّیَشۡهَدُوۡا مَنَافِعَ لَهُمۡ وَ یَذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰهِ فِیۡۤ اَیَّامٍ مَّعۡلُوۡمٰتٍ عَلٰی مَا رَزَقَهُمۡ مِّنۡۢ بَهِیۡمَۃِ الۡاَنۡعَامِ ۚ فَکُلُوۡا مِنۡهَا وَ اَطۡعِمُوا الۡبَآئِسَ الۡفَقِیۡرَ ﴿۫۲۸﴾

‘আর মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূর পথ পাড়ি দিয়ে। ‘যেন তারা নিজদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাযির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিয্ক দিয়েছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুস্থ-দরিদ্রকে খেতে দাও।’  (সুরা হজ : আয়াত ২৭-২৮)

وَ اَتِمُّوا الۡحَجَّ وَ الۡعُمۡرَۃَ لِلّٰهِ ؕ فَاِنۡ اُحۡصِرۡتُمۡ فَمَا اسۡتَیۡسَرَ مِنَ الۡهَدۡیِ ۚ وَ لَا تَحۡلِقُوۡا رُءُوۡسَکُمۡ حَتّٰی یَبۡلُغَ الۡهَدۡیُ مَحِلَّهٗ ؕ فَمَنۡ کَانَ مِنۡکُمۡ مَّرِیۡضًا اَوۡ بِهٖۤ اَذًی مِّنۡ رَّاۡسِهٖ فَفِدۡیَۃٌ مِّنۡ صِیَامٍ اَوۡ صَدَقَۃٍ اَوۡ نُسُکٍ ۚ فَاِذَاۤ اَمِنۡتُمۡ ٝ فَمَنۡ تَمَتَّعَ بِالۡعُمۡرَۃِ اِلَی الۡحَجِّ فَمَا اسۡتَیۡسَرَ مِنَ الۡهَدۡیِ ۚ فَمَنۡ لَّمۡ یَجِدۡ فَصِیَامُ ثَلٰثَۃِ اَیَّامٍ فِی الۡحَجِّ وَ سَبۡعَۃٍ اِذَا رَجَعۡتُمۡ ؕ تِلۡکَ عَشَرَۃٌ کَامِلَۃٌ ؕ ذٰلِکَ لِمَنۡ لَّمۡ یَکُنۡ اَهۡلُهٗ حَاضِرِی الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ﴿۱۹۶﴾

আর হজ ও উমরা আল্লাহর জন্য পূর্ণ কর। এর যদি তোমরা আটকে পড় তবে যে পশু সহজ হবে (তা জবাই কর)। আর তোমরা তোমাদের মাথা মুন্ডন করো না, যতক্ষণ না পশু তার যথাস্থানে পৌঁছে। আর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ কিংবা তার মাথায় যদি কোনো কষ্ট থাকে তবে রোজা কিংবা সদাকা অথবা পশু জবাইয়ের মাধ্যমে ফিদইয়া দেবে। আর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন যে ব্যক্তি ওমরার পর হজ সম্পাদনপূর্বক তামাত্তু করবে, তবে যে পশু সহজ হবে, তা জবাই করবে। কিন্তু যে তা পাবে না তাকে হজে তিন দিন এবং যখন তোমরা ফিরে যাবে, তখন সাত দিন রোজা পালন করবে। এই হলো পূর্ণ দশ। এই বিধান তার জন্য, যার পরিবার মাসজিদুল হারামের অধিবাসী নয়। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ আজাবদানে কঠোর।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৬)

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُحِلُّوۡا شَعَآئِرَ اللّٰهِ وَ لَا الشَّهۡرَ الۡحَرَامَ وَ لَا الۡهَدۡیَ وَ لَا الۡقَلَآئِدَ وَ لَاۤ آٰمِّیۡنَ الۡبَیۡتَ الۡحَرَامَ یَبۡتَغُوۡنَ فَضۡلًا مِّنۡ رَّبِّهِمۡ وَ رِضۡوَانًا ؕ وَ اِذَا حَلَلۡتُمۡ فَاصۡطَادُوۡا ؕ وَ لَا یَجۡرِمَنَّکُمۡ شَنَاٰنُ قَوۡمٍ اَنۡ صَدُّوۡکُمۡ عَنِ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اَنۡ تَعۡتَدُوۡا ۘ وَ تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَ التَّقۡوٰی ۪ وَ لَا تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ ۪ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ﴿۲﴾

‘হে মুমিনগণ! তোমরা অসম্মান করো না আল্লাহর নিদর্শনসমূহের, হারাম মাসের, হারামে প্রেরিত কোরবানির পশুর, গলায় চি‎হ্ন দেয়া পশুর এবং আপন রবের অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির অনুসন্ধানে পবিত্র ঘরের অভিমুখীদের। যখন তোমরা হালাল হও, তখন শিকার করো। কোন কওমের শত্রুতা যে, তারা তোমাদেরকে মসজিদে হারাম থেকে বাধা প্রদান করেছে, তোমাদেরকে যেন কখনো প্ররোচিত না করে যে, তোমরা সীমালঙ্ঘন করবে। সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা করো। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ আজাব প্রদানে কঠোর।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ২)

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقۡتُلُوا الصَّیۡدَ وَ اَنۡتُمۡ حُرُمٌ ؕ وَ مَنۡ قَتَلَهٗ مِنۡکُمۡ مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآءٌ مِّثۡلُ مَا قَتَلَ مِنَ النَّعَمِ یَحۡکُمُ بِهٖ ذَوَا عَدۡلٍ مِّنۡکُمۡ هَدۡیًۢا بٰلِغَ الۡکَعۡبَۃِ اَوۡ کَفَّارَۃٌ طَعَامُ مَسٰکِیۡنَ اَوۡ عَدۡلُ ذٰلِکَ صِیَامًا لِّیَذُوۡقَ وَبَالَ اَمۡرِهٖ ؕ عَفَا اللّٰهُ عَمَّا سَلَفَ ؕ وَ مَنۡ عَادَ فَیَنۡتَقِمُ اللّٰهُ مِنۡهُ ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ ذُو انۡتِقَامٍ ﴿۹۵﴾

‘হে মুমিনগণ! ইহরামে থাকা অবস্থায় তোমরা শিকারকে হত্যা করো না এবং যে তোমাদের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে তা হত্যা করবে তার বিনিময় হল যা হত্যা করেছে, তার অনুরূপ ঘরে লালিত-পালিত পশু, যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দুজন ন্যায়পরায়ণ লোক। কোরবানির জন্তু হিসাবে কাবায় পৌঁছতে হবে। অথবা মিসকীনকে খাবার দানের কাফ্ফারা কিংবা সমসংখ্যক রোজা পালন, যাতে সে নিজ কর্মের শাস্তি আস্বাদন করে। যা গত হয়েছে তা আল্লাহ ক্ষমা করেছেন। যে পুনরায় করবে আল্লাহ তার থেকে প্রতিশোধ নেবেন। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৯৫)

هُمُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ صَدُّوۡکُمۡ عَنِ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ وَ الۡهَدۡیَ مَعۡکُوۡفًا اَنۡ یَّبۡلُغَ مَحِلَّهٗ ؕ وَ لَوۡ لَا رِجَالٌ مُّؤۡمِنُوۡنَ وَ نِسَآءٌ مُّؤۡمِنٰتٌ لَّمۡ تَعۡلَمُوۡهُمۡ اَنۡ تَطَـُٔوۡهُمۡ فَتُصِیۡبَکُمۡ مِّنۡهُمۡ مَّعَرَّۃٌۢ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ۚ لِیُدۡخِلَ اللّٰهُ فِیۡ رَحۡمَتِهٖ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ لَوۡ تَزَیَّلُوۡا لَعَذَّبۡنَا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡهُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿۲۵﴾

‘তারাইতো কুফরি করেছিল এবং তোমাদেরকে আল-মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দিয়েছিল আর কোরবানির পশুগুলোকে কোরবানির স্থানে পৌঁছতে বাধা দিয়েছিল। যদি মুমিন পুরুষরা ও মুমিন নারীরা না থাকতো, যাদের সম্পর্কে তোমরা জান না যে, তোমরা অজ্ঞাতসারে তাদেরকে পদদলিত করবে, ফলে তাদের কারণে তোমরা দোষী হতে কিন্তু আমি তাদের উপর কর্তৃত্ব দিয়েছি যাতে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমতে প্রবেশ করাবেন। যদি তারা পৃথক থাকতো, তাহলে তাদের মধ্যে যারা কুফরি করেছে তাদেরকে আমি অবশ্যই যন্ত্রণাদায়ক আজাব দিতাম।’ (সুরা ফাতহ : আয়াত ২৫)

২. সাধারণ কোরবানি: যে কোরবানি হজ-ওমরার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এবং যার স্থানও নির্ধারিত নয়। তবে কোরবানির সময়টি নির্ধারিত। যে তারিখে হজ আদায়কারীগণ মিনা-মক্কায় কোরবানি করে থাকেন সে তারিখে অর্থাৎ জিলহজ মাসের ১০-১২ তারিখে এ কোরবানি দিতে হবে।

পৃথিবীর সব মুসলিম পরিবারের জন্য; বরং প্রত্যেক আকেল-বালেগ মুসলমানের জন্য এই কোরবানির বিধান এসেছে। তবে কারো জন্য তা ওয়াজিব, কারো জন্য নফল। কোরআনুল কারিমের একাধিক সুরা ও নবিজীর হাদিসে তা ওঠে এসেছে। তাহলো-

قُلْ اِنَّنِیْ هَدٰىنِیْ رَبِّیْۤ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ ۚ۬ دِیْنًا قِیَمًا مِّلَّةَ اِبْرٰهِیْمَ حَنِیْفًا ۚ وَ مَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ۝۱۶۱ قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ۝۱۶۲ لَا شَرِیْكَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ۝۱۶۳

‘আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক আমাকে পরিচালিত করেছেন সরল পথের দিকে-এক বিশুদ্ধ দ্বীনের দিকে, অর্থাৎ একনিষ্ঠ ইবরাহিমের মিল্লাতের (তরিকা) দিকে। আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার নামাজ, আমার নুসুক (কোরবানি), আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবকিছুই রাববুল আলামীন আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরিক নেই।  আমাকে এই আদেশই করা হয়েছে, সুতরাং আমি হলাম প্রথম আত্মসমর্পণ কারী।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১৬১-১৬৩)

এ আয়াতে ‘নুসুক’ শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটি ‘নাসিকাহ’ শব্দের বহুবচন, যার অর্থ, আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আল্লাহর নামে জবাইকৃত পশু। আর কোরবানির স্থানকে আরবি ভাষায় এবং শরিয়তের পরিভাষায় ‘মানসাক’ বলা হয়। দুটো শব্দের মূল ধাতু অভিন্ন।

উপরোক্ত আয়াতের অর্থও পরিষ্কার। আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে যে বিশুদ্ধ তাওহিদ ও সরল পথের সন্ধান দিয়েছিলেন; তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিও নাজিল করেছেন এবং আদেশ করেছেন যে, বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ সব আল্লাহ তাআলার জন্য।

হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিন দুটি দুম্বা জবাই করেছেন। জবাইয়ের সময় সেগুলোকে কিবলামুখী করে বলেছেন-

اِنِّیْ وَجَّهْتُ وَجْهِیَ لِلَّذِیْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ حَنِیْفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ  اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ  لَا شَرِیْكَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ ، بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبرُ، اَللّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ عَنْ مُحَمَّدٍ وَّأُمَّتِهِ (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে খুজাইমা)

সুরা কাউসারের দ্বিতীয় আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-

اِنَّاۤ اَعْطَیْنٰكَ الْكَوْثَرَؕ۝۱ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْؕ۝۲ اِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْاَبْتَرُ۠۝۳

এখানে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে গোটা উম্মতকে নামাজ ও ও নাহর তথা কোরবানির আদেশ দেওয়া হয়েছে। ‘নাহর’ শব্দের মূল অর্থ উট জবাই করা। তবে সাধারণ ব্যবহারে যেকোনো পশু জবাই করাকেই ‘নাহর’বলে। আয়াতে এমন জবাইয়ের উদ্দেশ্য; যা  ইবাদত হিসেবে করা হয়। সেটা হচ্ছে হজ ও ওমরার কোরবানি এবং ঈদুল আজহার সাধারণ কোরবানি।

এ কোরবানির সময় তিন দিন- জিলহজের দশ, এগারো ও বারো তারিখ। তবে উত্তম হল দশ তারিখ। সাধারণত এ তারিখেই অধিকাংশ কোরবানি হয়ে থাকে। এজন্য দশ জিলহজের ইসলামি নাম ‘ইয়াওমুন নাহর’। (বুখারি)

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল আজহার দিন নামাজ পরবর্তী খুতবায় বলেছেন, এই দিনের প্রথম কাজ হলো (ঈদের) নামাজ আদায় করা এরপর নহর (কোরবানি) করা। যে নামাজ আদায়ের পর নুসুক (কোরবানি) করলো তার নুসুক পূর্ণ হলো এবং সে মুসলিমদের পথ অনুসরণ করলো। আর যে নামাজের আগে জবাই করলো সেটা তার গোশতের প্রয়োজন পূরণ করবে, কিন্তু ‘নুসুক’ হিসেবে গণ্য হবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, কোরআনের আলোকে কোরবানির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। কোরআনের বিধানের আলোকে কোরবানি করা। কোরবানির মাধ্যমে নিজেদেরকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে উপস্থাপন করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের আলোকে উত্তমভাবে কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

রাজশাহীর সময়/এম