বর্তমানে চাল আমদানিতে সর্বমোট শুল্ক রয়েছে ৬২.৫ শতাংশ, যা ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে।
কোভিড-১৯ থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি, আমদানির উৎস কমে যাওয়ার কারণে তিন বছরে গমের আমদানি কমে অর্ধেকে নেমেছে। গমের ব্যবহার কমে যাওয়ার চাপটা পড়ছে চালে, একই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন কম হওয়ার কারণে এবারে চালের বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে সরকার শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র বলছে, শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। এই অনুমতি পাওয়ার পর এনবিআর শুল্ক কমানোর বিষয়ে কাজ করছে।
এনবিআর সূত্র বলছে, বর্তমানে চাল আমদানিতে সর্বমোট শুল্ক রয়েছে ৬২.৫ শতাংশ, যা ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা থেকেই শুল্ক কমিয়ে নন-বাসমতি সিদ্ধ ও নন-সেন্টেড আতপ চাল আমদানির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় উল্লেখ করে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ভারতের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে বিশ্ববাজারে গমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এ কারণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গমের আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারীভাবে গম আমদানি হয়েছে ৫৯.৯৮ লাখ মেট্রিক টন যা ২০২০-২১ এ নেমে আসে ৪৮.৬৪ লাখ মেট্রিক টনে। এই অর্থবছরের চলতি মাসের দুই তারিখ পর্যন্ত বেসরকারীভাবে গম আমদানি হয়েছে ৩১.০৮ লাখ মেট্রিক টন।
গমের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি কমে যাওয়ার কারণে দেশে আটার দাম বাড়ছে এবং চালের উপর চাপ তৈরি হয়েছে। এছাড়া আগাম বন্যা, ঝড় ও অতিবৃষ্টির কারণে হাওড়ে ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বোরো পরবর্তী মৌসুমে চালের মূল্য আরও অস্থিতিশীল হওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে আবাদ বেশি হলেও আগাম বৃষ্টি ও ঝড়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ধান মাটিতে পড়ে গিয়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া সিলেটসহ হাওড় অঞ্চলের অনেক জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা উচিত।
তবে চালের প্রকৃত উৎপাদনের তথ্য সরকারের হাতে না থাকায় নতুন করে চাহিদা বৃদ্ধি ও ঘাটতির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে আমদানির পরিমাণ নির্ধারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে। এখনো তারা ঠিক করতে পারেনি কী পরিমাণ চাল আমদানি করতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বৈদেশিক সংগ্রহ) মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান টিসিএসকে বলেন, 'আমদানির পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। শুল্ক কমানোর প্রজ্ঞাপন হয়ে গেলে তখন কী পরিমাণ চাল আমদানি করা হবে তা নিয়ে একটি সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
তিনি বলেন, 'চাল আমদানি করতে হবে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য। সরবরাহ বাড়াতে না পারলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে না।'
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মো জাহাঙ্গীর অলম টিবিএসকে বলেন, 'যখন কোন পণ্যের দাম বাড়বে এবং সরবরাহ কমবে তখন ভোক্তারা বিকল্পর দিকে যাবে। ফলে একসময় যারা ভাতের বিকল্প হিসেবে রুটি খাওয়া শুরু করেছিল তাদের একটা বড় অংশ গমের এই সংকটে আবার চালের দিকে যাবে যেটা খুবই স্বাভাবিক।'
তিনি বলেন, 'বিবিএস ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উৎপাদনের হিসেবে ব্যাপক ফারাক থাকে। এই অবস্থা থাকলে আমদানির জন্য কতটুকু দরকার তার সঠিক প্রক্ষেপণ সম্ভব হবে না। এজন্য উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা খুবই জরুরী।
বোরোর উৎপাদন কি কমবে
বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৪২৮.০৯ মেট্রিক টন। যেখানে চাল ৩৭৬.০৮ লাখ, গম ১০.৮৫ লাখ এবং ভুট্টা ৪১.১৬ লাখ মেট্রিক টন।
চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক খাদ্যশস্যের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৬৫.৮২ লাখ মেট্রিক টন। যেখানে চাল ৩৯৪.৮১ লাখ, গম ১২.২৬ লাখ ও ভুট্টা ৫৮.৭৫ লাখ মেট্রিক টন।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, এবারে বোরো মৌসুমে ৪৯,৬৩,১৯৮ হেক্টরে বোরোর আবাদ হয়েছে। অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, ও ঝড়ো আবহাওয়ায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টন চালের উৎপাদন কমবে। তারপরও মন্ত্রণালয় দাবি করছে, এবারে বোরো মৌসুমে ২ কোটি ১১ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হতে পারে।
বিবিএসের হিসেবে গত বছর বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ টন, যেখানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপন ছিল ২ কোটি ৮ লাখ টনের।
এবারে বিবিএস কর্তৃক চলতি বোরো মৌসুমের উৎপাদনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ৭টি বিভাগের ২০ জেলায় বিবিএস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের কয়েকটি টিম সরেজমিন ঘুরে আসে।
কর্মকর্তাদের তথ্য বলছে, এবারে পাহাড়ি ঢলে হাওড় অঞ্চলে বেশ ক্ষতি হয়েছে। অতিবৃষ্টিতে সারাদেশেই ধানের ক্ষতি হয়েছে। শেষ মুহূর্তে যখন ধান পেকে গেছে তখনকার বৃষ্টি ও ঝড়ে অনেক অঞ্চলের ধান মাটিতে পড়ে যায়। গত বছরের চেয়ে অনেক জায়গায় জমির পরিমাণও কমেছে। সে হিসেবে উৎপাদনের পরিমাণ ১ কোটি ৯৮ লাখ টনেরও নিচে নেমে আসতে পারে।
তবে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে দাবি করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা সামান্য, গত বছরের চেয়ে এবারও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
সরকারি সংগ্রহ নিয়েও শঙ্কা
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে বোরো মৌসুমে ১১ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৫০ হাজার টন আতপ চাল ও সাড়ে ছয় লাখ টন বোরো ধান সংগ্রহ করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এর বিপরীতে চলতি মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত ১,০১,৬১০ টন ধান, ৪,৫১.১০৫ টন সিদ্ধ চাল এবং ৭৭৮০ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সভার কার্যপত্র থেকে জানা যায়, আগাম বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে হাওড় সহ বিভিন্ন অঞ্চলে ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ধান সংগ্রহের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সম্ভবনা বেশি।
সরকার ১০৮০ টাকা মূল্যে প্রতি মণ ধান সংগ্রহ করছে, যেখানে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকা বা তারও বেশি দামে। একই অবস্থা চালের দামেও। সংগ্রহ মূল্য ৪০ টাকা কেজি হলেও বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম এখন ৫০ টাকার বেশি। এ কারণে ধান ও চালের সংগ্রহ অভিযান শতভাগ সফল নাও হতে পারে বলে আলোচনায় উঠে আসে।
চলতি অর্থবছরে ৩৩.৯৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত ৩১শে মার্চ পর্যন্ত ২৮.৮২ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে অবশিষ্ট সময়ের জন্য আরো ৫.১১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বিতরণ করতে হবে। একই সাথে আগামী ১ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭.২৭ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য (১২.৯৮ লাখ টন চাল ও ৪.২৯ লাখ টন গম) বিতরণ করতে হবে।
এর মধ্যে আবার বড় চ্যালেঞ্জ হলে, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা মজুদ হিসেবে ৮.৫০ লাখ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ মেট্রিক টন গম রাখা। এ কারণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরো ১৩.৪০ লাখ টন চাল ও ৬.৭৩ লাখ টন গম সংগ্রহ করা আবশ্যক।
বর্তমানে সরকারিভাবে ১৫.৪৯ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ১৩.২৪ লাখ টন চাল ও ১.৬৫ লাখ টন গম রয়েছে।