নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকদের ‘বাপ ডাকিয়ে দেব’ এবং ‘তোমরা সোজা হয়ে যাও’ এমন হুমকি দেয়ায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে সাংবাদিক মহলে।
ইতিমধ্যে প্রতিবাদ সভা ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিকরা। অন্যথায় বৃহৎ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে এর উচিত জবাব দেয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা।
গত শনিবার (২ নভেম্বর) বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা থানাধীন এনায়েতনগর ইউনিয়নের ধর্মগঞ্জ চট্টলার মাঠে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে হুমকিমূলক এমন বক্তব্য দেন। যার ভিডিও ফুটেজ সময় সংবাদের হাতে এসেছে।
গিয়াস উদ্দিনের এই বিতর্কিত বক্তব্যের ভিডিও চিত্র ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘সাংবাদিকদের মধ্যে ভালো আছে, খারাপ আছে, আবার হলুদ সাংবাদিকও আছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যারা শেখ হাসিনার দালালি করেছে তাদেরকেও আমরা চিনি। এখনও অনেক সাংবাদিক আছে যারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দালালি করেছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যদি মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেন আপনাদের ছেড়ে দেয়া হবে না। এখানকার (ফতুল্লার) তেল চোর, মাঠ চোর, এমন ব্যক্তি একটি সংবাদপত্র কিনেছে। নারায়ণগঞ্জে সেটা পরিচালনা করছে। বাপ ডাকিয়ে দেব কিন্তু। তোমরা যারা কলম লিখ, মিথ্যা লিখ। তোমাদের ছাড় দেওয়া হবে না। শুধু সাংবাদিক বলে তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে চোখ রাঙাবে, কুৎসা রটনা করবে। আমরা কি চুপ থাকবো?’
ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে হুমকি দিয়ে গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘ফতুল্লা প্রেস ক্লাব তোমরা সোজা হয়ে যাও। তোমাদের আমরা চিনি কারা কারা সেখানে আছ। সেখানে কারা কোন বাড়ির, কোন ফ্যামিলির, কার কতটুকু পড়াশোনা, কার কেমন আচরণ, কার কেমন সততা ও বুদ্ধিমত্তা সবকিছু আমরা জানি। কাউকে ছেড়ে দেব না কিন্তু। আমি রাজনীতি করি, আন্দোলন সংগ্রাম করি। তোমাদের ভয় পাই না।’
জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াসউদ্দিনের এই বক্তব্যের পরদিন রোববার (৩ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের জরুরি সভা করে সাংবাদিক নেতারা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সোমবার (৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নিয়াজ মো. মাসুম সময় সংবাদকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াসউদ্দিন সাহেব দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন। তার মতো রাজনীতিবিদের মুখে সাংবাদিকদের প্রতি হুমকিমূলক এমন বক্তব্য কেউই আশা করে না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি যখন এমপি ছিলেন তখন অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছেন তার এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্নগণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। দেশের পট পরিবর্তনের পর এবার যাতে সাংবাদিকরা তার বিরুদ্ধে না লিখে সেজন্য শুরু থেকেই তিনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সাংবাদিকদের হুমকি দিচ্ছেন। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে তিনি ৫ আগস্টের পর থেকে একের পর এক বিএনপির প্রতিটি সভা সমাবেশে প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকদের বলেছেন ‘তোমরা সোজা হয়ে যাও’। আর নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকদের বলেছেন ‘তাদেরকে বাপ ডাকিয়ে দেব’।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নিয়াজ মো. মাসুম আরও বলেন, ‘আমরা গিয়াস উদ্দিন সাহেবের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা ফতুল্লা প্রেস ক্লাব গতকাল জরুরি সভা করেছি। আগামিকাল মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছি। ফতুলার যত সাংবাদিক সংগঠন ও সাংবাদিকরা আছে তাদের আমরা আহবান করেছি। তারা সবাই থাকবে। আমাদের দাবি হচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে যেন জরুরি ভিত্তিতে গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। তা না হলে আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন সহ ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করবো।’
এ ঘটনায় ক্ষোভ ও তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনয়ন অন্তর্ভুক্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন নারায়ণগঞ্জের সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সাউদ মাসুদ।
প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের সাথে এমন আচরণ কোনাভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এটা প্রস্তর যুগ না যে, আপনি সাংবাদিকদের হুমকি দিবেন আর সাংবাদিকরা আপনার অন্যায়, অবিচার, লুটপাট, দখলবানিজ্য, হাট-ঘাট, পাথর ঘাট দখল, চাঁদাবাজি মেনে নিয়ে নিউজ করবে না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে বস্তু নিষ্ঠতার সাথে সাংবাদিকতা করে আসছি এটা চলমান থাকবে। কে কী বলল আর কে কী হুমকি দিল এতে সাংবাদিকরা বিন্দুমাত্র ভয় পায় না।’
সাংবাদিকদের হুমকির বিষয়ে গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে সাংবাদিক নেতা আবু সাউদ মাসুদ বলেন, ‘তার এই বক্তব্যের বিষয়ে দলের হাই কমান্ডে জানানো হয়েছে। তার বিষয়ে আমরা দলীয় সিদ্ধান্ত চাই। এখন বিএনপির হাই কমান্ড কী সিদ্ধান্ত দেন সে পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। যারা সাংবাদিকদের হুমকি ধামকি দিচ্ছে, প্রেসক্লাব দখল করতে যারা নেপথ্যে থেকে হামলা করেছে তাদের বিষয়ে আমরা বিএনপির হাই কমান্ডে জানিয়েছি। দলীয় সিদ্ধান্তের পর আমরা আমাদের কর্মসূচী দেব।’
সাংবাদিকদের হুমকি দেয়ার বিষয়ে কথা বলতে সোমবার (৪ নভেম্বর) রাত আটটা থেকে সময় সংবাদের এ প্রতিবেদক নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও বন্ধ পাওয়া যায়।