০৫ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:২১:৫৪ পূর্বাহ্ন


এবার শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ৫৮ এসআইকে অব্যাহতি ‘কোন অদৃশ্য কারণে অব্যাহতি জানি না’
অনলাইন ডেস্ক :
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-১১-২০২৪
এবার শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ৫৮ এসআইকে অব্যাহতি ‘কোন অদৃশ্য কারণে অব্যাহতি জানি না’


‘আজ (সোমবার) আমাদের সমাপনী কুচকাওয়াজ হওয়ার কথা। আমরা চাকরিতে যোগ দিতে কর্মস্থলে যাব। কিন্তু কোন অদৃশ্য কারণে আমাদের অব্যাহতি দিল, নিজেরাও জানি না। বাপ-মায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা সব শেষ। ২৫২ জনকে যখন বের করে দিল, তখন এ খবর শুনে এক ব্যাচমেটের মা মারা গেছেন। এর দায় কে নেবে? আমার চাকরির বয়স শেষ; এখন আমি কী করব?’

হতাশাভরা মুখ আর ভেজা চোখ নিয়ে রাজশাহীর বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কথাগুলো বলছিলেন মাদারীপুরের রাসেল। তিনি এসআই পদে চাকরি পেয়ে এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষ করেন গতকাল সোমবার। এদিনই পুলিশ একাডেমি থেকে তাঁকে অব্যাহতির কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়। শুধু রাসেল নন, যে ৩১০ জনের চাকরি গেছে, সবাই একবুক হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।


গতকাল দুপুরে অব্যাহতিপত্র ও নিজেদের মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে যান ৫৮ জন। এর আগে গত ২৪ অক্টোবর ক্লাসে হইচই করে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে ৫৯ জনের বিরুদ্ধে। পরে তাদের শোকজ করা হয়েছিল। একইভাবে গত ২১ অক্টোবর ২৫২ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সকালের নাশতা নিয়ে তারা মাঠে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ছিল।    

এসআই পদে চাকরি হারিয়ে নেত্রকোনার সুমন মিয়া পুলিশ একাডেমি থেকে চলে যাওয়ার সময় চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘আজ (গতকাল) আমাদের প্রশিক্ষণের শেষ দিন ছিল। অনেক স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কিন্তু আজ প্রশিক্ষণ শেষে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছি।’


অব্যাহতি পাওয়া আরেক এসআই মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা মাঠে এক বছর প্রশিক্ষণ করেছি। কোনো দিন বিশৃঙ্খলা হয়নি। কিন্তু কাল্পনিক সব অভিযোগ এনে আমাদের বের করে দিল। আমরা আইনি লড়াইয়ে যাব। আল্লাহ যদি চায়, আমরা আবার চাকরি ফিরে পাব।’ অব্যাহতি পাওয়া এসআই আমান উল্লাহ বলেন, ‘আমরা মাঠে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। বিকেলে আমাদের মাঠে নামতে নিষেধ করল। পরে আমাদের ৫৯ জনকে চেমনি মেমোরিয়াল হলে ক্লাসে ডাকা হয়। আমরা সবাই মন খারাপ করে ছিলাম। কেউ কোনো হইচই করেনি। পরে হইচই করার কল্পনিক অভিযোগ এনে আমাদের বের করে দিল।’

অনামিকা সাহা নামে অব্যাহতি পাওয়া এক নারী এসআই বলেন, ‘আমরা মর্মাহত।’  

এর আগে দুপুরে অব্যাহতিপ্রাপ্ত এসআইরা কেউ হাতে ব্যাগ, আবার কেউ ভ্যানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসেন। এ সময় গেটের বাইরে অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের দেখে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। 


একজন এসআইর মা বলেন, ‘কারণ দর্শানোর নোটিশ পাওয়ার পর আমার মেয়েকে অব্যাহতি দেওয়া হবে– এটা ভেবে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মেয়েকে নিতে সকাল থেকেই গেটে অপেক্ষা করছি। শুধু দুঃখ একটাই, কোনো অপরাধ না করলেও ঘটনা সাজিয়ে তাদের অপরাধী বানানো হয়েছে।’ 

পুলিশ একাডেমির তথ্যমতে, ৪০তম ব্যাচের আউটসাইডার ক্যাডেট হিসেবে মোট ৮০৪ জন প্রশিক্ষণরত ছিলেন। ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর এই ক্যাডেট এসআইদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা ছিল ৪ নভেম্বর।


অব্যাহতি পাওয়া ৫৮ এসআই হলেন– ইমরান হোসেন, জয় কলিন্স সরকার, আবু সালেহ, সাজ্জাদ হোসেন, দিদার আলম, আব্দুর রহমান, আহসান হাবীব, রইস উদ্দিন, রাফিন মিয়া, মাসুম পারভেজ তারেক, ফখর উদ্দিন তালুকদার, ইফতেখারুল ইসলাম, নাজির হোসেন, আমান উল্লাহ, রকিবুল হাসান, অম্লান মিত্র, নাজমুল আলম, আব্দুর রহমান, পল্লব হোসেন, আবু বকর, রুবেল হোসেন, মেহেদী হাসান, তারেক আজিজ, মেহেদী হাসান, মেহেদী হাসান জয়, তারেক রহমান চৌধুরী, কেএম জুবায়ের তানিম, জুবায়ের রাশেদ, মোস্তফা দাউদ, আরিফুল ইসলাম, লাভলু মিয়া, সুমন মিয়া, শাহারিয়ার হাসান কিবরিয়া, রাসেল, কাওছার, বদিউল হাসান রিফাত, মিনহাজ উদ্দিন খাদিম, রেজাউল করিম, কাওসার খান, জোবায়ের হোসেন, ওমর ফারুক, ফখরুদ্দীন বেপারী, সোহাগ শরীফ, মোহাম্মদ গোফরানুল হাসিব, আলী নাঈম, আফজাল হোসেন, আরাফাত হোসাইন, রবিউল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, সোহাগ মোল্লা, শাকিল শেখ, সাইমুন সাল-সাবিলা, মোবাস শিরিন, খায়রুন নাহার, চম্পা রানী দাস, সাইমা আফসানা মুমু, অনামিকা সাহা ও আয়শা সিদ্দিকা।


গত ২১ অক্টোবর ২৫২ জন এসআইকে অব্যাহতি দেওয়ার পর গত ২৪ অক্টোবর ৫৯ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ ক্লাসে এলোমেলোভাবে বসে হইচই করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে। সে সময় পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান ভুঞা বলেন, ‘এটা একটা রুটিন ওয়ার্ক। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে এ ধরনের নোটিশ দেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে কোনো রাজনীতি নাই।’ তবে গতকাল তাঁর বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি। 


২০২৩ সালে এসআই পদে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত ৮০৪ জন সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণে ছিলেন। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসআই পদে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিএনপি। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অভিযোগ তুলে পুলিশের নিয়োগ বাতিলের দাবি করে দলটি। এ ছাড়া গত ২০ অক্টোবর সারদায় সহকারী পুলিশ সুপারদের সমাপনী কুচকাওয়াজ হওয়ার কথা ছিল। সেদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এর আগের দিন রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক ফেসবুকে তাদের আওয়ামী লীগের দোসর উল্লেখ করে স্ট্যাটাস দিলে সব আয়োজন হঠাৎ স্থগিত করা হয়।