২৮ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৪:৪১:৫৩ অপরাহ্ন


সবার জন্য পেনশনে ছয় স্তরের পরিকল্পনা
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৫-২০২৩
সবার জন্য পেনশনে ছয় স্তরের পরিকল্পনা ফাইল ফটো


ছয় ধরনের প্রোডাক্ট স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী প্রায় ১০ কোটি নাগরিককে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাগ করে এই স্কিম নির্ধারণ করা হচ্ছে। এগুলো হলো—১. বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিজীবী পেনশনার স্কিম, ২. প্রবাসী/অনিবাসী পেনশনার স্কিম, ৩. শ্রমিকশ্রেণি স্কিম, ৪. অপ্রাতিষ্ঠানিক জনগোষ্ঠী স্কিম, ৫. সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিভুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি ফান্ডেড স্কিম এবং ৬. শিক্ষার্থী স্কিম। আগামী জুলাই শেষে এসব স্কিমের আওতায় আগ্রহী পেনশনারদের নিয়ে পাইলটিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। শুরুতে মডেল জেলা হিসেবে রাখা হবে ঢাকাসহ দেশের অন্য যে কোনো একটি জেলাকে। খবর অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রতিটি প্রোডাক্ট স্কিম হবে স্বতন্ত্র। সব প্রোডাক্টেই একটি ন্যূনতম চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। কেউ চাইলে বেশিও জমা করতে পারবে। কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত তহবিলে সংশ্লিষ্ট প্রোডাক্ট স্কিমের হিসাবে যার যত বেশি চাঁদা জমা পড়বে, তার আর্থিক সুবিধা পাওয়ার হারও তত বেশি হবে।

তবে কে কোন ক্যাটাগরির প্রোডাক্ট স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন, তা নির্ধারণ করবেন এ উদ্দেশ্যে গঠিত সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের নিয়োগপ্রাপ্ত অফিসিয়ালরা। এক্ষেত্রে আগ্রহী পেনশনারের বয়স, কর্মক্ষেত্র, আয় এবং সামাজিক মর্যাদা তথা নির্ধারিত হারে চাঁদা দেওয়ার সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্য প্রোডাক্ট স্কিম ঠিক করা হবে। আইন অনুযায়ী এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর একজন নিবন্ধিত পেনশনারকে অন্তত ১০ বছর কিস্তি চালিয়ে যেতে হবে।

২০২০ সালে দেশে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ। এই সংখ্যা ২০৪১ সালে ৩ কোটি ১০ লাখ হবে বলে অনুমান করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো না থাকায় বৃদ্ধকালে তাদের জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে। ওই সময় তাদের স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বর্তমান সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে।

এ লক্ষ্যে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষ গঠনের দাপ্তরিক আদেশ জারি হয়েছে। এখন চলতি মাসের বাকি সময়ে অথবা জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ দেওয়ার কথা রয়েছে। সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ভবনের কোনো একটি ফ্লোরে তাদের দাপ্তরিক কার্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব গ্রহণের আগেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার অগ্রবর্তীমূলক কাজকর্ম গুছিয়ে রেখেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অর্থাৎ, এ সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন, তদানুযায়ী তার বিধিমালা ও নীতিমালার খসড়া কৌশলপত্র তৈরির কাজও শেষ। উদ্দেশ্য, কর্তৃপক্ষ নিয়োগ সম্পন্ন হওয়ার পর পরই যেন তারা ত্বরিত গতিতে পাইলটিংয়ের কাজ শুরু করতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গঠিত কর্তৃপক্ষ এক-দুটি সভা করে এ ৬ ধরনের প্রোডাক্ট স্কিমের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন এবং এসব স্কিমের অফিসিয়াল নামও ঠিক করবেন। অবশ্য কর্তৃপক্ষ চাইলে এক-দুটি প্রোডাক্ট বাড়াতেও পারেন। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও মডেল দেশগুলোর দৃষ্টান্ত তারা নিশ্চয়ই পর্যালোচনা করবেন এবং সে অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নেবেন।

এ ছয় স্তরে সর্বজনীন পেনশন চালুর পরিকল্পনা কতটা যৌক্তিক জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে জানান, প্রোডাক্ট স্কিম যত কম থাকবে, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা তত গতিশীল হবে। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এটা ৫ স্তরের বেশি হওয়া উচিত নয়। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এ ব্যবস্থার দরকার নেই। এর পরিবর্তে দেশে যে একটা বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আছে, তাদের জন্য ‘বিজনেস ম্যান পেনশনার স্কিম’ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সরকারি চাকরিজীবীদেরও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নিয়ে আসা উচিত। বাকি স্তরগুলো সঠিক বলেই মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

জানা গেছে, গণচীন তার সব নাগরিককে পেনশন সুবিধা দিতে বর্তমানে ৩ ধরনের এবং ভারতে ৭ ধরনের প্রোডাক্ট স্কিম চালু রেখেছে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও বলছেন, সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ও জনগোষ্ঠী আমলে নিলে এই প্রোডাক্ট স্কিম ৬ থেকে ৭-এর বেশি হওয়ার কথা নয়।

সরকারের মেয়াদপূর্তির আগে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরই হলো শেষ বাজেট। ২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে রাখা সেই অবাস্তবায়িত উদ্যোগ সবার জন্য পেনশন বা ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে আসন্ন বাজেটে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা ইস্যুতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বক্তব্যে সরকারের সব কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সবকিছু স্পষ্ট করা হবে। এই নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার কাঠামো গঠন, প্রোডাক্ট স্কিম ঠিক করা এবং কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জনশুমারি ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হালনাগাদ ভোটার তালিকা সমন্বয় করে অর্থ মন্ত্রণালয় এই হিসাব পেয়েছে—১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী দেশে নিবাসী-অনিবাসী মিলে এমন নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি।

যারা পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। তবে সবার জন্য বাধ্যতামূলক না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে এই জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কেবল আগ্রহীদেরই এই ছয় ধরনের প্রোডাক্ট স্কিমের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, যে কটি প্রোডাক্ট স্কিম চালু করা হবে, তার মধ্য থেকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিভুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত সরকারি ফান্ডেড স্কিমে অন্তর্ভুক্তদেরই কেবল নির্ধারিতহারের চাঁদার একটা অংশ সরকার বহন করবে।

বর্তমানে দেশে ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী জনসংখ্যা রয়েছে মোট জনগোষ্ঠীর ১৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ বা ৩ কোটি ২০ লাখ। জনসংখ্যার এই শ্রেণিকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় শিক্ষার্থী মডেল হিসেবে ধরা হবে।

৩৫ বছরের কম বয়সীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশের কিছু বেশি বা ১০ কোটি ৮৭ লাখের কিছু বেশি। এই শ্রেণির বড় অংশ চাকরিজীবী। তারা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় আপাতত সরকারি চাকরিজীবীদের বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে কাজ করছে জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ। যাদের বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিজীবী স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত রয়েছে দেশের ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। এ তালিকায় রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, কৃষকসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িতরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।

দেশে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন খাতে কাজ করছে—এমন নাগরিকের বেশিরভাগই হলো শ্রমিকশ্রেণির। কেবল পোশাক খাতেই এ সংখ্যা ৪৫ লাখ। এর বাইরে নির্মাণ শ্রমিক জাহাজভাঙা শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল শ্রমিকসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক রয়েছেন। এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের জন্য পৃথক পেনশন ব্যবস্থা থাকছে। তার নাম হতে পারে শ্রমিকশ্রেণির পেনশনার স্কিম। বিদেশে কর্মরত রয়েছেন—দেশে এমন অনিবাসী নাগরিকের সংখ্যা প্রায় সোয়া কোটি। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধ বয়সে পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করতে চালু করা হচ্ছে প্রবাসী/অনিবাসী পেনশনার স্কিম।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, পাইলটিং মডেল স্কিমের মেয়াদ হতে পারে সর্বনিম্ন এক বছর থেকে সর্বোচ্চ দুই অর্থবছর। এ কার্যক্রমে পাইলটিং জেলাতে নিবন্ধিত পেনশনারদের মাসিক কিস্তি সংগ্রহের দায়িত্বে থাকবে স্থানীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশে প্রচলিত মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসরাও (এমএফএস)। বিভিন্ন স্থান থেকে পেনশনারদের জমা করা ওই অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ হয়ে যাবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রিত সার্ভারে। এর সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ একই পদ্ধতিতে সারা দেশে বিস্তৃত করা হবে। তবে শুরুর প্রক্রিয়াটি হবে সীমিত পরিসরে। ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ সারা দেশে চালু হওয়ার পর অন্তত পাঁচ বছর তা ঐচ্ছিক রাখা হবে। পরে ২০২৮-২০৩০ সালের মধ্যে এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে।

এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া কালবেলা প্রতিবেদককে জানান, ‘দেশে যত দ্রুত সম্ভব সর্বজনীন পেনশন প্রথা চালু করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই আন্তরিক। জুলাই ২০২৩-এর মধ্যেই এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রবিধি-১ অধিশাখা) মনির হোসেন চৌধুরী কালবেলাকে জানান, সব কিছুই প্রায় প্রস্তুত। কর্তৃপক্ষ গঠনও এখন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। আগামী জুলাই থেকে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ স্কিমের পাইলটিং শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে আসন্ন বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী সরকারের কর্মপরিকল্পনার কথা জানাবেন।

সবার জন্য পেনশন আওয়ামী লীগের গত আমলের চিন্তা। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে তিনি একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। এ জন্য পাইলট প্রকল্পের কথা বলেছিলেন তিনি। সর্বজনীন পেনশনকে মুহিত তার স্বপ্নের প্রকল্প বলেও উল্লেখ করেন।