নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অথরাইজড অফিসার মোঃ আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরে একই পদে বহাল থাকাসহ নানা অনিয়মে গ্রেফতার হয়েও বহাল তবিয়তে রয়েছে তিনি।
আরডিএ‘র চেয়ারম্যান বদলি হলেও একই পদে আবুল কালাম আজাদ। অথরাইজড অফিসারের পদ থেকে যেন কোনোভাবেই হটানো যাচ্ছে না তাকে। প্রশ্ন উঠেছে, আজাদের খুঁটির জোর নিয়ে।
সূত্র জানিয়েছে, আরডিএ'র প্ল্যানিং সেক্টরে প্রায় ২৫-২৮ বছর ধরে কর্মরত রয়েছেন মোঃ আবুল কালাম আজাদ। তিনি নগরীতে ভবন উন্নয়নের প্ল্যান পাশ করান। কিন্তু মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ফাইল ছাড়েন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। নির্ধারিত ফি ছাড়াও দিতে হয় মোটা অংকের উৎকোচ। এছাড়া হয়রানি করা হয় প্রতিনিয়ত।এক কথায় এ সেক্টরে হরিলুট চলছে বলেও অভিযোগ।
তথ্য মতে, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের যে ক’জন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদ তাদের মধ্যে অন্যতম। ২০০৭ সালে ঘুষ গ্রহণের সময় তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের অভিযোগে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীর গোরহাঙ্গা রেলগেট থেকে সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন ও ছাড়পত্র প্রদানের ফলে সরকারের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ক্ষতি সাধনের অভিযোগ অনুসন্ধান করেন দুদক।
নামে বেনামে আবাসিক (আরডিএ) এলাকায় একাধিক প্লট রয়েছে আবুল কালাম আজাদের। নগরীর ভিআইপি এলাকা বলে পরিচিত ভদ্রা আবাসিক এলাকায় বসবাস করেন তিনি। মূলত পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন ঢাকায়। সেখানেও আবাসন রয়েছে তার। প্রতি সপ্তাহে ঢাকায় যাতায়াত করেন আজাদ। সূত্র বলছে, বৃহস্পতিবার ঢাকা গিয়ে রবিবার রাজশাহী এসে অফিস করেন আজাদ। বিমানে যাতায়াত করেন তিনি। এছাড়া ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন সরকারি গাড়ি।
আরডিএ সূত্র জানায়, আরডিএ’র অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদের দুর্নীতির নথিপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) পাঠানো হয়। ২০১৪ সালের ১১ জুন দুদকের সহকারী পরিচালক রিজিয়া খাতুন চিঠি দিয়ে আরডিএ’র চেয়ারম্যানকে আবুল কালাম আজাদের দফতর সংশ্লিষ্ট একটি প্রকল্পের সব ফাইল সরবরাহের অনুরোধ করলে সম্প্রতি তা দুদকের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ১৫ জুন রাজশাহী মহানগরীর মাস্টার প্ল্যান গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। মাস্টার প্ল্যানে গোরহাঙ্গা-সাহেববাজার সড়কটি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু অথরাইজড অফিসার ২০০৫ সালের ২২ ডিসেম্বর বিপুল আর্থিক সুবিধা নিয়ে সড়ক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত এলাকায় বেজমেন্টসহ দুটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের প্ল্যান পাস ও ছাড়পত্র প্রদান করেন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বহুতল বিশিষ্ট ইসলামী ব্যাংক আঞ্চলিক ভবনও ছিল। অনুমোদনের পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণ কাজ শুরু করে।
সম্প্রতি চলতি বছরের ৭-৭-২০২৪ তারিখে দুদকের অভিযান রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অথরাইজড অফিসার মোঃ আবুল কালাম আজাদের অফিসে।
জানা গেছে, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অথরাইজড অফিসার মোঃ আবুল কালাম আজাদের অফিস থেকে বিভিন্ন ফাইল জব্দ সহ উদ্ধার করে নিয়ে যায় দুদক।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, আবুল কালাম আজাদের কাছে কেউ প্ল্যান পাসের জন্য গেলে তাকে মাটি ও কাঠামো থেকে প্ল্যান এবং মাটি পরীক্ষা করে আনতে বলা হয়। কেউ তার কথা না শুনলে বছরের পর বছর প্ল্যানের জন্য অথরাইজড শাখায় ঘুরতে হয়। হতে হয় সীমাহীন হয়রানি।
এদিকে ২০০৯ সালের শুরুর দিকে সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় অবৈধভাবে অনুমোদন দেয়া নির্মাণাধীন ভবন দুটি ভেঙে ফেলা হয়। আর এজন্য ভবন মালিকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়।
দুদকের সূত্রগুলো বলছে, আবুল কালাম আজাদ ও অথরাইজড শাখার সাবেক ইমারত পরিদর্শক আবুল কাশেম মিলে সরকারের এ বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি করেছেন। এই দুই কর্মকর্তা শুধু নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্যই সরকারের সড়ক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত জমিতে বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদন করে স্পষ্টভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে।
দুদক সূত্র আরও জানায়, আবুল কালাম আজাদ তার ভাইয়ের নামে দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীতে মাটি ও কাঠামো নামের একটি কনসাল্টেশন ফার্ম চালাচ্ছিলেন। তবে প্রতিষ্ঠানটি আরডিএতে তালিকাভুক্ত নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১০ বছরে লাখ লাখ টাকা খরচ হলেও আরডিএ‘র রাজশাহীর ‘প্রান্তিক আবাসিক প্রকল্প’ নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। ১০ বছর আগে মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তাসহ ১৪ কর্মকর্তা দুই দফায় বিদেশ সফর করেন। প্রকল্পের টাকায় ২০১৩ সালে দুই দফায় ১৫ দিন করে ১৪ কর্মকর্তা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেন। প্রকল্পের টাকা থেকে ১৪ কর্মকর্তার ভ্রমণ ব্যয় বাবদ ৯৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। বছর বছর কর্মকর্তাদের গাড়ির পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়। নগরীর গোয়ালপাড়া ও কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় ‘প্রান্তিক আবাসিক প্রকল্প’ বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিকভাবে ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রকল্পটির ব্যয় ৪৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ধরা হয়।
এরমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ৩৪ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা ছিল। প্রায় ২০ একর আয়তনের প্রকল্পটিতে ২৪৫টি প্লট হওয়ার কথা। বর্তমানে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে ৯৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। শুরুতে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। এরপর ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বর্ধিত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০১৭ সালের ৩০ জুন ও ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপর থেকে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে।
ওই প্রকল্পের টাকায় বিদেশ ভ্রমণকারীদের মধ্যে ছিলেন আরডিএ‘র অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদও। অন্যান্য কর্মকর্তারা হলেন- গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব ও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব এসএম আরিফ উর রহমান, আরডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান নৌপরিবহন সচিব আব্দুস সামাদ, সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমান প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজীবুল ইসলাম, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাবেক একান্ত সচিব ও বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রতন চন্দ্র পÐিত, গৃহায়ন অধিদফতরের সাবেক পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক বেগম লুৎফুন্নেসা, মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা কোষের সাবেক ডেপুটি চিফ জালাল আহাম্মেদ, সাবেক পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আব্দুর রহমান আকন্দ, আরডিএ’র হিসাব কর্মকর্তা বাসারুল কবির, নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল তারিক, সহকারী প্রকৌশলী ও প্রান্তিকের প্রকল্প পরিচালক শেখ কামরুজ্জামান, সহকারী নগর পরিকল্পক রাহেনুল ইসলাম রনি ও সহকারী এস্টেট অফিসার মাজহারুল ইসলাম। তবে এখনো পর্যন্ত সেই পদেই রয়ে গেছেন ক্ষমতাবান আবুল কালাম আজাদ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ব্যপারে জানতে আরডিএর অথরাইজড অফিসার মোঃ আবুল কালাম আজাদের ব্যাক্তিগত মুঠো ফোনে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।