২২ ডিসেম্বর ২০২৪, রবিবার, ০৪:৩৩:০৬ অপরাহ্ন


নতুন শিক্ষাব্যবস্থার যুগে বাংলাদেশ
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০২-২০২৩
নতুন শিক্ষাব্যবস্থার যুগে বাংলাদেশ ফাইল ফটো


স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অসংখ্যবার পরিবর্তন এসেছে। প্রত্যেক পরিবর্তনেই কিছু না কিছু বিষয় নতুন করে যোগ হয়েছে।

বলা হয়েছে, যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতেই এসব পদক্ষেপ। কিন্তু এই প্রথম দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা একেবারেই খোলনলচে বদলে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সনাতনী পাঠদানের মতো থাকছে না শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়া। শিক্ষকরা পড়ানোর পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন।

শিক্ষার্থীরা তোতাপাখির মতো প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করবে না। সামষ্টিক মূল্যায়ন বা পরীক্ষার পরিবর্তে তাদের সারা বছর ধরে মূল্যায়ন করা হবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত থাকছে না কোনো পরীক্ষা। হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। এই মূল্যায়ন কেবল শিক্ষক নন; পাশাপাশি শিক্ষার্থীর সহপাঠী, তার বাবা-মা কিংবা অভিভাবক এবং সমাজের অংশীজনও মূল্যায়ন করবেন।

ফলে শিক্ষার্থী পাঠ্যবই থেকে কতটুকু শিখল তা নির্ধারণ কেবল শিক্ষকের হাতে থাকছে না। এসব কারণে নোট-গাইড আর কোচিংয়ের কবল থেকে মুক্তির পথ তৈরির সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। সবমিলে শিখনফলকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যোগ্যতাভিত্তিক শিখনফলের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।

আর এভাবে বাস্তবজীবন থেকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করে ছাত্রছাত্রীরা নিজেকে বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারবে।

নতুন ও স্বপ্নের শিক্ষাব্যবস্থার তফাত জানতে দেশের তিন সিনিয়র নাগরিকের মুখোমুখি হয়েছে যুগান্তর। সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার মুসতাক আহমদ ও বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার মাহাদী হাসান।

শিক্ষার মাধ্যমে ঐক্য নয় বিভাজন করছি: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এটি ভালো ফলাফল নিয়ে আসছে না। এই যে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এটা কেন আনা হলো, আবার কেন প্রত্যাহার করা হলো কিছুই বুঝলাম না। সরকারের ইচ্ছা হলো ব্যাস একটা পরীক্ষা দিয়ে দিল। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমরা শিক্ষার্থীর চেয়ে পরীক্ষার্থীই বেশি তৈরি করছি। মা-বাবাও মনে করে ভালো ফলাফল করতে হবে।

এজন্য শ্রেণিকক্ষের পড়ালেখার ওপর নির্ভর করলে চলবে না বরং কোচিং সেন্টার লাগবে, গাইড বই লাগবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। সে কারণে শিক্ষা একটি পণ্যের মতো বিক্রি হচ্ছে। মঙ্গলবার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল সমস্যা হচ্ছে এটি তিনটি ধারায় বিভক্ত। একটি শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধারা থাকতে পারে কিন্তু অন্য দেশে জাতীয় পর্যায়ে তিনটি সুস্পষ্ট ধারা আছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের উচিত শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মাঝে ঐক্য আনা। সেটি না করে শিক্ষার মাধ্যমে আমরা বিভাজন করছি। আমাদের শিক্ষার ধারা একটিই হওয়া উচিত এবং সেটি মাতৃভাষাতেই। সেটি আমরা এখনো করতে পারিনি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার যে মূল্য বাংলাদেশে সেটি কমে যাচ্ছে। এখানে কর্তৃত্ব করে মুনাফা এবং অর্থ। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি, উন্নয়ন হচ্ছে না। বরং এটি নিুমুখী সে কারণে শিক্ষার গুরুত্বও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না। আর কর্মসংস্থান না বাড়লে শিক্ষিত বেকার তৈরি হয়। শিক্ষিত বেকার সমাজের জন্য কোনো ভালো জিনিস নয়। এই যে মানুষকে শিক্ষিত করা হচ্ছে কিন্তু কর্মের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, সে কারণে আগ্রহও কমে যাচ্ছে। শিক্ষা মানুষ নিচ্ছে কারণ তাদের অন্য কিছু করার নেই। আগের দিনে এমএ পাশ করলে একটি বড় চাকরির প্রত্যাশা করত কিন্তু এখন সেইরকম প্রত্যাশা নেই। এই যে শিক্ষা ও কর্মের মাঝে একটা ফারাক সেটার কারণে শিক্ষার মানের উন্নয়ন হচ্ছে না।

শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেই গবেষণাও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করা হয় না। আর শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ভালো শিক্ষক প্রয়োজন। ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষা দেওয়া যাবে না। ভালো শিক্ষক মানে হচ্ছে-মেধাবী এবং শিক্ষকতায় যারা আগ্রহী। এসব ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আনতে হলে তাদের বেতন-ভাতা, সম্মান দুটোই বাড়াতে হবে। এটা আমরা না পারায় উপযুক্ত শিক্ষকও পাচ্ছি না। আর উপযুক্ত শিক্ষক না পেলে শিক্ষার মান বাড়বে না। এগুলো আমাদের সমস্যা।

বিশ্ব নাগরিক তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা চাই: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে, সেই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চাই আমরা। এজন্য যা কিছু প্রয়োজন, সব যেন শ্রেণিকক্ষ থেকেই অর্জন করা সম্ভব হয়। বর্তমান বিশ্বে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি এবং আরও অন্তত একটি ভাষা জানা জরুরি। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, স্প্যানিশ ভাষার কথা। দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিল বাদে আর সব দেশেই এই ভাষা গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, আর্জেন্টিনা বাংলাদেশে দূতাবাস খুলছে। এই দেশসহ অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক দিগন্ত খুলে যাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাই এই ভাষা শেখা প্রয়োজন। এভাবে গুরুত্ব অনুযায়ী অন্যান্য ভাষা শেখার ওপর জোর দিতে হবে শিক্ষাব্যবস্থায়। পাশাপাশি একটি কথা মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক ভাষার একটি সংস্কৃতি থাকে। এটিকে বলে ‘সাংস্কৃতিক যোগাযোগ’। ভাষা শেখার সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগও শেখানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। মঙ্গলবার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা এবং এ নিয়ে তার স্বপ্নের কথা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি বর্তমানে চিকিৎসাসহ নানান ক্ষেত্রে রোবোটিক্স ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব বিদ্যা এবং তা কাজে লাগানোর শিক্ষা জরুরি। নইলে আমাদের পিছিয়ে পড়তে হবে। দৃষ্টান্ত হিসাবে নার্সিং শিক্ষার কথা বলা যেতে পারে। শুধু দেশের ভেতরে নয়, বাইরেও নার্সের কর্মসংস্থানের বাজার অবারিত। নার্সদের কাজ কেবল আগের মতো রোগীর বিছানাপত্র গুছানো আর ওষুধ খাওয়ানোর মধ্যেই সীমিত নয়। ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে তাকে রোগীর সংকটকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়। এখন নার্সকে যদি সেভাবে গড়ে তুলতে হয় তবে নার্সিং শিক্ষাক্রম আধুনিকায়ন ও প্রয়োজনের নিরিখে সাজাতে হবে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছে এ দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী। তাদের গড়ে তুলতে বৈশ্বিক চাহিদা সামনে রেখে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তকসহ গোটা শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো প্রয়োজন। ২০২১ সালে শিক্ষাক্রমের যে রূপরেখা তৈরি করা হয়, এর আদলে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই লেখা হয়েছে। এতে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি স্থান পেয়েছে।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরীর মতো দুজন মানুষ এই শিক্ষাক্রম নিয়ে লেগে না থাকলে এবার যে পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে, সেটা সম্ভব হতো না। এখানেই বেধেছে বিপত্তি। নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক অনেকেরই স্বার্থে আঘাত হানবে। কেননা এতে বিশেষ করে কোচিং আর নোট-গাইড ব্যবসা বিঘ্নিত হবে।

সুতরাং এই কেন্দ্রিক যে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা আছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। পাশাপাশি আরও কোনো কোনো মহল থেকেও কথা ওঠা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, যারা এই আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগিতার প্রতিবন্ধক হবে, অগগ্রতি স্তব্ধ করে দিতে চাইবে; তাদেরকে আমরা জয়লাভ করতে দেব কি না।

আমি মনে করি, যে শিক্ষাক্রম আর পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তা ৩-৪ বছর চালাতে পারলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।

নয়া শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক লক্ষ্য অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে তিনটি পক্ষের নিবিড় সহযোগিতা প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে-রাজনৈতিক, বিনিয়োগগত ও সামাজিক। প্রধানমন্ত্রী গত দেড় দশকে শিক্ষায় অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন। তার অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। দৃষ্টান্ত হিসাবে দুটি বিষয় বলা যায়। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি এখনো অবাস্তবায়িত।

কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন উচ্চশিক্ষার একটি কৌশলপত্র করেছে। সেটিও বাস্তবায়নের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। কোনো নীতি ও কৌশলপত্র নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। সেটা আলোচনাসাপেক্ষে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করা যেতে পারে। কিন্তু যেভাবে প্রতিবন্ধকতা আসছে তাতে শেষ পর্যন্ত সবকিছু হিমাগারে চলে যায় কি না, সেই সংশয় রয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া নীতি ও কৌশলপত্রগুলো বাস্তবায়িত হবে না।

আরও কিছু বিষয় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া হবে না। সেগুলোর মধ্যে আছে-শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতি দূর করা, মেধা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষাঙ্গনে লেখাপড়া ও গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি প্রভৃতি। এভাবে শতরকম অপকীর্তি থাকতে পারে। সেগুলো দূর করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তার মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি ছাড়া আরও একটি দিকে দৃষ্টি প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে শিক্ষায় বিনিয়োগ। শিক্ষকদের বেতনভাতা, প্রশিক্ষণ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, বিদ্যালয়সহ শ্রেণিকক্ষের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রভৃতি সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষা পুরোপুরি বিনা খরচায় যাতে নিশ্চিত করা যায়, সেই পরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন।

শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে এই পেশাকে আকর্ষণীয় করতে হবে যাতে সবচেয়ে মেধাবীরা তাদের চাকরির পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে রাখেন শিক্ষকতাকে এবং এই পেশায় আসার পরে তিনি কারও বা কোনোকিছুর প্রতি আর্থিকভাবে মুখাপেক্ষী না থাকেন। যদি বিদ্যালয়ে ১ লাখ টাকা বেতন দেওয়া হয়, তাহলে শিক্ষক গ্রামেও থাকবেন। আর তার স্বামী যদি ডাক্তার হন, তাহলে তিনি শহরের পরিবর্তে মফস্বলে থাকতেও আগ্রহী হবেন। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার উন্নয়নের সঙ্গে গ্রামীণ ও মফস্বলের স্বাস্থ্যসেবারও উন্নতি করা সম্ভব। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তনে বড় বিনিয়োগ দরকার। এক্ষেত্রে তাড়াহুড়োর পন্থা বন্ধ করতে হবে। এক বছর ধরে শিক্ষাক্রম তৈরি, এরপর আরও এক বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক তৈরির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এরপর পাইলটিং করে তা চালু হলে তা ঘন ঘন পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে না।

এভাবে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা গেলে সত্যিকার সৃজনশীল মানুষ পাওয়া যাবে। তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নজর দিতে হবে যে, বিনিয়োগ যেন প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার মুখে না পড়ে।

নতুন শিক্ষাক্রম যে স্বপ্ন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে, তা অর্জন করতে হলে তীব্র সামাজিক সমর্থন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। এতে গতানুগতিক শিখন-শিক্ষণ, বাড়ির কাজ এবং মূল্যায়ন বা পরীক্ষায় পরিবর্তন এসেছে। বাচ্চাদের লেখাপড়া নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে। অভিভাবক এবং সমাজ ধৈর্যের সঙ্গে যেন বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেন, সেটি জরুরি। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সহযোগিতা প্রয়োজন। কেননা গণমাধ্যম বা এতে যারা ইতিবাচক ভাবমূর্তিসহ শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসছেন, তাদের প্রতিবেদন ও মতামত জনগণের সমর্থন আদায় ও প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সহায়ক হবে।

প্রতিবছর আমাদের বিপুলসংখ্যক জনশক্তি বিদেশে লেখাপড়া করতে যায়। সেখানে কেউ এমএ, কেউবা পিএইচডি ডিগ্রি নেন। সাম্প্রতিককালে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট করতেও অনেকে যাচ্ছে। তাদের বড় একটা অংশ ফিরে আসে না। এখন যে অংশটি বিদেশে পড়তে যায়, তার মেধার বিকাশ ত্বরান্বিত করতে স্কুলেই ব্যবস্থা থাকতে হবে। দেশের ভেতরে চাকরির ক্ষেত্র বলতে সরকারি, ব্যাংকসহ বেসরকারি খাত। কিন্তু কেবল এই জগতের জন্য গ্র্যাজুয়েট তৈরির দিকে মনোনিবেশ করলে এ জাতি বিশ্ব নাগরিক হওয়ার মতো গড়ে উঠবে না। কেবল সরকারি আর বেসরকারি চাকরির জগৎ কোনো ‘রোল মডেল’ (পথিকৃৎ) হতে পারে না। বৈশ্বিক চাহিদাই এক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় পৃথিকৃৎ হতে হবে।

শিক্ষা সংস্কার উদ্যোগ সাহসী ও ইতিবাচক: রাশেদা কে চৌধুরী

গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক এবং শিক্ষা আন্দোলনের প্রাজ্ঞ নেত্রী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন তরুণ শিক্ষার্থী প্রজন্মের একজন আমি। সংগ্রাম, চেতনা, স্বাধীনতার স্বপ্ন সবই ছিল আদর্শিক। শুধু শিক্ষা ও অর্থনৈতিক নয়, সামগ্রিকভাবে মানবিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আমরা বড় হয়েছি। যদিও পরবর্তীকালে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে প্রত্যাশার জায়গা অনেক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। মঙ্গলবার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার মনোভাব তুলে ধরেন।

দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে গেলে শিক্ষায় বিদ্যমান বিভিন্ন ধারা-উপধারার কথা বলা যায়। আজ পর্যন্ত অভিন্ন ধারার একীভূত শিক্ষা হয়নি। ফলে সব দিক থেকে শিক্ষায় বৈষম্য বিরাজ করছে। শিক্ষাটা বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে এমনভাবে পণ্যে পরিণত হয়েছে যে, সেটি আর মানবাধিকারের বিষয় হিসাবে নেই। যেসব ব্যক্তি বা পরিবার আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নতি করতে পেরেছে, কেবল তারাই শিক্ষার নানান সুযোগ-সুবিধাটা পাচ্ছেন। এর ফলে জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ শিক্ষায় প্রবেশাধিকার (অ্যাকসেস) পায়নি। অথবা যারা পেয়েছে তারা সেই শিক্ষা পেশাগত দক্ষতা ও কর্মজীবনসহ পরবর্তী জীবনে কাজে লাগাতে পারেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, তা যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে এই বিশৃঙ্খলার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হতো। শিক্ষায় এত শাখা-প্রশাখা আর লাগামহীনতা দেখা যেত না।

এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় আরেকটি দিক হচ্ছে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের পিছু হটা। একদিকে অপ্রতুল বরাদ্দ দেখা যাচ্ছে। আবার যথাস্থানে যথাসময়ে যথাযথ বিনিয়োগ হয়নি। শিক্ষায় সার্বিকভাবে আইন-কানুন প্রতিষ্ঠায় নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে আনা কিংবা বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরার কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বর্তমানে সরকারের শিক্ষা সংস্কার উদ্যোগ খুবই সাহসী, সময়োপযোগী ও ইতিবাচক।

এর মাধ্যমে মূলত এই প্রথমবারের মতো খোলনলচে বদলে ফেলা হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায়। মনে রাখতে হবে যে, ভালো ও স্বপ্নের কিছু হলেও তা বাস্তবায়নে নানান চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে। নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবইসহ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে চারটি পক্ষ জড়িত। তারা হলেন-শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যারা বাস্তবায়নে মূল কাজ করবে তাদের দক্ষতা আর নিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। এখানেই নিহিত বড় চ্যালেঞ্জ।

অন্যদিকে তাড়াহুড়ো করে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কিছু ভুল-ত্রুটি হয়ে গেছে। শিক্ষককে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়নি। অনলাইনে কিছু রিফ্রেশার (পরিচিতিমূলক) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এটা চলমান থাকবে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেককে দুটি প্রশিক্ষণ অবশ্যই দিতে হবে। এর একটি হচ্ছে ‘সার্বিক’ আরেকটি ‘বিষয়ভিত্তিক’। ইতোমধ্যে ভুল শোধরানোর কথা এসেছে। কমিটিও হয়েছে।

যে পরিমার্জন করা হবে সেটা শিক্ষককে জানাতে হবে। নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান শিক্ষক আর শিক্ষা প্রশাসন দিয়ে বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব সেই তথ্য শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকতে হবে।

এখানে বলা প্রয়োজন যে, আমরা যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে যাচ্ছি তা যে কটি কারণে তার অন্যতম এসডিজি (জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি)। এই এসডিজিতেই যথাযথ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কাজ করার নির্দেশনা আছে। তথ্য-উপাত্ত না থাকলে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে না। তেমনি অনেক ভালো উদ্যোগ সফল না হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। যেমন-দুই বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হচ্ছে। এজন্য শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক ইত্যাদি কী পরিমাণ আছে, কী ঘাটতি আছে-এসব জানা অতি জরুরি।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে শিক্ষায় বিনিয়োগ। বিনিয়োগ করলেই হবে না, তা যথাস্থানে, যথাসময়ে যথাযথ হতে হবে। নইলে এর থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন সম্ভব নয়। তাই এ ক্ষেত্রে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। বিনিয়োগ আর পরিকল্পনার পাশাপাশি দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগে মনোনিবেশ করতে হবে। এখনো প্রতিষ্ঠান প্রধান জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে নিয়োগ করা হচ্ছে না।

মনে রাখতে হবে, কোনো কাজ সফলতার সঙ্গে সম্পন্নের জন্য ‘নেতৃত্ব’ গুরুত্বপূর্ণ ও মূল শক্তি। একই সঙ্গে সাধারণ শিক্ষকের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশেষ করে তাদের বেতনভাতা, মর্যাদা আর প্রশিক্ষণে মনোযোগ দরকার সরকারের। শিক্ষা ক্যাডারকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার বড় অংশ পরিচালিত হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশকে সরকার অনুদান (এমপিও) দেয়। পাশাপাশি অবকাঠামোসহ আরও কিছু সুবিধা দেয়। সুতরাং অনেক অবদান রাখছে সরকার। ওইসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবক-শিক্ষক মিথষ্ক্রিয়া নিয়মিত করতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে সমাজের অংশগ্রহণমূলক শিখন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেটি কীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে-সেটা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জানাতে হবে। এর পাশাপাশি বিনিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি তৈরি ও ব্যবহার, শ্রেণিকক্ষ উপযুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা এমনভাবে করতে হবে যেন শহর আর মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য না থাকে। বিনিয়োগে যে ভালো কিছু হয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ক্যাডেট কলেজ। সেই দৃষ্টান্ত সব ক্ষেত্রে চাই আমরা।

দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়নি। এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন কর্মসূচিতে (পিইডিপি) নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অবিলম্বে প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টির পাশাপাশি এই খাতের জন্য পদসোপান তৈরি করতে হবে।

একজন শিক্ষক সারাজীবন স্কুলে পড়ে থাকবেন কেন? শিক্ষা ক্যাডার থেকে মহাপরিচালক হতে পারলে প্রাথমিক শিক্ষা খাত থেকে কেন মহাপরিচালক হতে পারবেন না। এভাবে শিক্ষা প্রশাসনে যত গরমিল আছে তা দূর করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম ভালো উদ্যোগ। বাস্তব ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আদর্শিক ও স্বপ্নের জায়গায় আমরা যেতে চাই-সবই ঠিক আছে। কিন্তু বিনিয়োগ, যথাযথ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে খরচ, সুশাসন, মনিটরিং আর সর্বোপরি দক্ষতা ও নিষ্ঠা না থাকলে ভালো উদ্যোগও সফলভাবে বাস্তবায়িত হয় না।