করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে সরকার। সংকট মোকাবিলায় দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়ানো ও আবাদযোগ্য কৃষিজমি পতিত না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১১ কোটি শতক পতিত বা অনাবাদি জমি রয়েছে, যা মোট জমির প্রায় ৫ শতাংশ। পতিত এসব জমি আবাদের জন্য ইতোমধ্যে একাধিক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে।’ প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নে চিনিকল, পাটকল, বস্ত্রকল ও রেলের চাষযোগ্য পতিত জমিতে আবাদের উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রীকে আধা-সরকারিপত্র (ডিও) দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে বিভাগীয় কমিশনারদের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কঠোর বার্তা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গতকাল সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনারদের সভায় এ বার্তা দেওয়া হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। জানা গেছে, গতকাল দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে বিভাগীয় কমিশনারদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। বৈঠকে বিভাগীয় কমিশনারদের বলা হয়, তারা যেন ডিসিদের এই বার্তা দেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দেশের এক ইঞ্চি আবাদযোগ্য জমিও পতিত থাকবে না। পাশাপাশি কৃষির উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা শতভাগ নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের কঠোর নজরদারি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভাগীয় কমিশনারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কমিশনারদের আরও বলা হয়, প্রবাসীদের আয় বৈধ পথে আনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বালুমহালের ইজারা পদ্ধতি আধুনিকায়ন করতে হবে। যেসব বালুমহাল ইজারার বাইরে রয়েছে সেগুলো ইজারার আওতায় আনতে হবে। ভূমি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব বিষয়ে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা চাই দেশে আবাদযোগ্য কোনো জমি পতিত থাকবে না এবং কৃষির সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে দেশের চিনিকল, পাটকল, বস্ত্রকল ও রেলের চাষযোগ্য পতিত জমিতে আবাদের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের সহযোগিতা চেয়ে আধা-সরকারি পত্র দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক। তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ কামনা করে কৃষিমন্ত্রী চিঠিতে বলেন, বৈশ্বিক প্রতিকূল অবস্থায় সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অব্যবহৃত চাষযোগ্য জমিতে খাদ্যশস্য, শাকসবজি, ডাল ও তেলবীজ চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান চিনিকল, পাটকল, বস্ত্রকল ও রেলপথের অব্যবহৃত বা পতিত জমিতে আবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। আবাদের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি অফিসার প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন।
পত্রে আরও বলা হয়, কভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সেই সঙ্গে সার ও জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি এবং সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় খাদ্য সংকটের আশঙ্কা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও কোনো জমি যেন পতিত না থাকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয় উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ফসলের আবাদ এলাকা বৃদ্ধি, বসতবাড়িতে পুষ্টিবাগান স্থাপন ও প্রতিষ্ঠানের পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে মোট ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ২২৬ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার একর। পরিবারপ্রতি জমির পরিমাণ প্রায় ৮২ শতক। এসব জমির মধ্যে বসতবাড়ি, পুকুর, স্থায়ী ফসলি জমি, অস্থায়ী ফসলি জমির পাশাপাশি পতিত জমিও রয়েছে। এর মধ্যে দুই ধরনের অর্থাৎ অস্থায়ী পতিত ও স্থায়ী পতিত জমি রয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার একর। অস্থায়ী পতিত জমি বলতে বোঝায় যেসব জমিতে চলতি বছর আবাদ বা কোনো ধরনের শস্য উৎপাদন হয়নি কিন্তু আগের বছর আবাদ হয়েছে। এমন জমির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৫৩ লাখ ৫৫ হাজার একর। পরিবারপ্রতি এ ধরনের জমি রয়েছে গড়ে প্রায় এক শতক। অন্যদিকে কখনোই কোনো ধরনের আবাদ ও শস্য উৎপাদন হয়নি এমন জমিকে বলা হয় স্থায়ী পতিত জমি, যার পরিমাণ প্রায় ৯ কোটি ৩১ লাখ ৫৯ হাজার একর। পরিবারপ্রতি এ ধরনের পতিত জমি রয়েছে গড়ে প্রায় তিন শতক। বছরের পর বছর এসব জমি পতিত থাকছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পতিত জমির বেশির ভাগ মালিক এসব জমির কাছাকাছি বসবাস করেন না। তারা চাকরির কারণে হোক আর ব্যবসা, নিজের বসতবাড়ি বা মালিকানাধীন জমি থেকে দূরে বসবাস করেন। ফলে এসব জমির বেশির ভাগই সারা বছর অনাবাদি থেকে যায়। কিছু জমি মাঝেমধ্যে চাষাবাদ হলেও তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।