মুমিনের প্রতিদিনের এবং আজীবনের মূল আমল হলো আল্লাহর তাআলার নির্দেশ পালন করা, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যা কিছু করা সম্ভব তা করার চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা যে কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা। মানুষের জীবন সফল হয় আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলে, জান্নাত লাভ করার উপযুক্ত হতে পারলে।
তবে এই লেখায় প্রতিদিনের সব আমলের কথা আমরা বলছি না। শুধু সহজ ও ফজিলতপূর্ণ ছয়টি আমলের কথা বলছি, যা আমরা প্রতিদিন করতে পারি এবং এই আমলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে পারি।
১. প্রতিদিনের আমল: যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুন
ইসলামে ইমানের পর নামাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ৮২ বার সরাসরি নামাজের কথা বলেন। নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত রয়েছে।
কোরআনে যথা সময়ে নামাজ আদায় ফরজ উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় নামাজ মুসলমানদের ওপর ফরজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। (সুরা নিসা: ১০৩)
প্রতিদিন যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় একজন মুমিন ও মুসলমানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যদি কোনো অসুবিধার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায় করা না যায়, তাহলে সুযোগ পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব নামাজ কাজা করে নিতে হবে।
২. প্রতিদিনের আমল: ইস্তেগফার পড়ুন
ইস্তেগফার আল্লাহ তাআলার ক্ষমা পাওয়ার উপায়। এছাড়া এটি একটি পৃথক ইবাদতও বটে। সজ্ঞানে কোনো গুনাহ না করলেও জানা-অজানা, ছোটবড় সব গুনাহের জন্য সব সময় আল্লাহ তাআলার কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকা উচিত। এটা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের বড় মাধ্যম।
কারণ ইস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার প্রতি বান্দার ইমান, আনুগত্য ও মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ পায়। আল্লাহর প্রতি ভরসা ও নির্ভরতা প্রকাশ পায়। বিনয় ও অহংকারহীনতা প্রকাশ পায়। বান্দা যখন সত্যিকার অনুশোচনা নিয়ে নিজের অসহায়ত্ব ও আল্লাহর কাছে মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার পাশাপাশি তার দিকে সন্তুষ্টি ও রহমতের দৃষ্টি দেন। ফলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই সে বরকত ও রহমত লাভ করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালা। (সুরা নুহ: ১০-১২)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি সব সময় ক্ষমা চায়, আল্লাহ তাআলা তার জন্য প্রত্যেক সংকীর্ণতা হতে বের হয়ে আসার পথ খুলে দেন, প্রত্যেক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করেন। (সুনানে আবু দাউদ: ১৫১৮)
তাই ইস্তেগফারকে প্রতিদিনের আমল বানান। কাজের ফাঁকে, অবসরে যখনই সুযোগ পান ইস্তেগফার পড়ুন।
৩. প্রতিদিনের আমল: দরুদ পড়ুন
আল্লাহর রাসুলের (সা.) জন্য দরুদ পড়া অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তাআলা কোরআনে তার রাসুলের জন্য সালাত ও সালাম পাঠের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ নবির প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবির জন্য দোয়া করে। হে মুমিনগণ, তোমরাও নবির ওপর দরুদ পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও। (সুরা আহজাব: ৫৬)
অনেকগুলো হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) তার জন্য বেশি বেশি দরুদ পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আমার জন্য একবার দরুদ পড়বে, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। (সহিহ মুসলিম)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বার্ণিত আরেকটি হাদিসে এসেছে, আল্লাহর রাসুলের জন্য দরুদ পাঠকারী কেয়ামতের দিন তার কাছে থাকবে। রাসুল (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন লোকদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই আমার অধিক নিকটতম হবে, যে ব্যক্তি আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করবে। (সুনানে তিরমিজি)
‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ আল্লাহর রাসুলের (সা.) প্রতি সংক্ষীপ্ত দরুদ বা দোয়া যা আমরা তার সম্মানিত নাম উচ্চারণ করলে বা শুনলে পড়ে থাকি। ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ অর্থ হলো, আল্লাহ তার ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। এ ছাড়া অন্যান্য দীর্ঘ দরুদও রয়েছে যেগুলো আমরা প্রতিদিন বারবার পাঠ করতে পারি।
৪. প্রতিদিনের আমল: কোরআন তিলাওয়াত করুন
কোরআন মহান আল্লাহ তাআলার কালাম। মানুষের কাছে পাঠানো আল্লাহর বার্তা। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ বুঝতে, তার ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন গড়তে প্রতিদিন গভীর মনোযোগ দিয়ে চিন্তা ভাবনা করে যতটুকুই সম্ভব হয় কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সুরা সোয়াদ: ২৯) আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তবে কি তারা কোরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহ তালাবদ্ধ? (সুরা মুহাম্মাদ: ২৪)
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা চান আমরা যেন নিয়মিত কোরআনের মর্ম অনুধাবন করে কোরআন পাঠ করি। আল্লাহ কী বলেছেন, কী বুঝিয়েছেন তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করি। কোরআন অর্থ না বুঝে পাঠ করলেও সওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু অর্থ বুঝে কোরআন পাঠের সওয়াব নিঃসন্দেহে অনেক বেশি।
৫. প্রতিদিনের আমল: আল্লাহর জিকির করুন
আল্লাহর স্মরণ সর্বক্ষণ অন্তরে জাগরুক রাখা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি কাজে আল্লাহর বিধান ও সন্তুষ্টির কথা মনে রাখা একজন মুমিনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। জিকির শুধু মুখে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার নাম নয়, আল্লাহর যেকোনো ধরনের আনুগত্য ও ইবাদতও জিকির। দোয়া, ইস্তেগফার, তিলাওয়াত ও দ্বীনি আলোচনাও আল্লাহর জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। একইসাথে আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করা বা আল্লাহর প্রশংসা, পবিত্রতা বর্ণনা, মহত্ত্ব ও বড়ত্বের ঘোষণা মুখে উচ্চারণ করাও আল্লাহর জিকির এবং অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় কর, আমার সাথে কুফরি করো না। (সুরা বাকারা: ১৫২) আরেকটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তুমি নিজ মনে আপন রবকে স্মরণ কর সকাল-সন্ধ্যায় অনুনয়-বিনয় ও ভীতি সহকারে এবং অনুচ্চ স্বরে। আর গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। (সুরা আ’রাফ: ২০৫)
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ থাকা ব্যক্তিদের কঠিন পরিণতি উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত। আর তাকে কেয়ামতের দিন ওঠাব অন্ধ করে। (সুরা ত্বহা: ১২৪)
এ আয়াতগুলোতে ‘আল্লাহর স্মরণ’ অর্থ সামগ্রিকভাবে আল্লাহর আনুগত্য করা, তার বিধান মেনে জীবন পরিচালনা করা। পাশাপাশি মুখে আল্লাহর জিকির করা; তার প্রশংসা, পবিত্রতা বর্ণনা, বড়ত্ব ঘোষণা এবং শুধু তার ইলাহ হওয়ার স্বীকৃতি উচ্চারণ করাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে।
প্রতিদিন আল্লাহর যথাসাধ্য আনুগত্য করার পাশাপাশি মুখেও বেশি বেশি আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করুন। যখনই সুযোগ পান বলুন: ‘সুবাহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’।
৬. প্রতিদিনের আমল: সালাম দিন
ইসলামে সালাম অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসুল (সা.) বেশি বেশি সালাম দিতে উৎসাহিত করে বলেছেন সালাম মুসলমানদের পারস্পরিক সৌহার্দ ও ভালোবাসা বাড়ায়। নবিজি (সা.) বলেন, সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! আপনারা মুমিন না হলে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না আর পরস্পরে সৌহার্দ ও ভালোবাসা না রেখে আপনারা মুমিন হতে পারবেন না। আমি আপনাদের এমন কাজের কথা বলছি যা আপনাদের পারস্পরিক সৌহার্দ বৃদ্ধি করবে, নিজেদের মধ্যে বেশি বেশি সালাম আদান-প্রদান করুন! (সহিহ মুসলিম: ২০৩)
তাই সালাম একজন মুমিনের প্রতিদিনের আমল হওয়া উচিত। কারো সাথে দেখা হলে আগে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। দুইজন মুসলমানের মধ্যে দেখা হলে যে আগে সালাম দেয়, সে বেশি উত্তম, আল্লাহর বেশি নৈকট্যপ্রাপ্ত। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত নবিজি (সা.) বলেন, মানুষের মধ্যে আল্লাহর বেশি নৈকট্যপ্রাপ্ত সে, যে প্রথম সালাম দেয়। (সুনানে আবু দাউদ: ৮৫৮)
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, কোনো এক সাহাবি নবিজিকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! দুইজন ব্যক্তির মধ্যে দেখা হলে তাদের মধ্যে কে আগে সালাম দেবে? নবিজি (সা.) বললেন, যে মহান আল্লাহর বেশি নৈকট্যপ্রাপ্ত, সে আগে সালাম দেবে। (সুনানে তিরমিজি: ৩৬৯৪)
আর কেউ সালাম দিলে তার সালামের উত্তর যথাযথভাবে উচ্চারণ করে এবং সালামদাতাকে শুনিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদেরকে যখন অভিবাদন করা হয়, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম প্রত্যাভিবাদন করবে অথবা তার অনুরূপ করবে। (সুরা নিসা: ৮৬)
এ আয়াতে ‘অভিবাদন’ বলে সালাম উদ্দেশ্য। আয়াতের মর্ম হলো কেউ সালাম দিলে আরও উত্তম শব্দে সালামের জবাব দিতে হবে। অর্থাৎ ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে এবং ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম দিলে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’ বলে সালামের জবাব দিতে হবে।
যদি আরও উত্তম শব্দে জবাব দেওয়া না যায়, তবে অন্তত সালামদাতা যে শব্দে সালাম দিয়েছে, অনুরূপ শব্দে জবাব দিতে হবে। অর্থাৎ ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলে জবাবে অন্তত ‘ওয়ালাকুমুস সালাম’ বলতে হবে।
তবে এই লেখায় প্রতিদিনের সব আমলের কথা আমরা বলছি না। শুধু সহজ ও ফজিলতপূর্ণ ছয়টি আমলের কথা বলছি, যা আমরা প্রতিদিন করতে পারি এবং এই আমলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে পারি।
১. প্রতিদিনের আমল: যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুন
ইসলামে ইমানের পর নামাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ৮২ বার সরাসরি নামাজের কথা বলেন। নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত রয়েছে।
কোরআনে যথা সময়ে নামাজ আদায় ফরজ উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় নামাজ মুসলমানদের ওপর ফরজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। (সুরা নিসা: ১০৩)
প্রতিদিন যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় একজন মুমিন ও মুসলমানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যদি কোনো অসুবিধার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায় করা না যায়, তাহলে সুযোগ পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব নামাজ কাজা করে নিতে হবে।
২. প্রতিদিনের আমল: ইস্তেগফার পড়ুন
ইস্তেগফার আল্লাহ তাআলার ক্ষমা পাওয়ার উপায়। এছাড়া এটি একটি পৃথক ইবাদতও বটে। সজ্ঞানে কোনো গুনাহ না করলেও জানা-অজানা, ছোটবড় সব গুনাহের জন্য সব সময় আল্লাহ তাআলার কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকা উচিত। এটা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের বড় মাধ্যম।
কারণ ইস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার প্রতি বান্দার ইমান, আনুগত্য ও মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ পায়। আল্লাহর প্রতি ভরসা ও নির্ভরতা প্রকাশ পায়। বিনয় ও অহংকারহীনতা প্রকাশ পায়। বান্দা যখন সত্যিকার অনুশোচনা নিয়ে নিজের অসহায়ত্ব ও আল্লাহর কাছে মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার পাশাপাশি তার দিকে সন্তুষ্টি ও রহমতের দৃষ্টি দেন। ফলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই সে বরকত ও রহমত লাভ করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালা। (সুরা নুহ: ১০-১২)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি সব সময় ক্ষমা চায়, আল্লাহ তাআলা তার জন্য প্রত্যেক সংকীর্ণতা হতে বের হয়ে আসার পথ খুলে দেন, প্রত্যেক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করেন। (সুনানে আবু দাউদ: ১৫১৮)
তাই ইস্তেগফারকে প্রতিদিনের আমল বানান। কাজের ফাঁকে, অবসরে যখনই সুযোগ পান ইস্তেগফার পড়ুন।
৩. প্রতিদিনের আমল: দরুদ পড়ুন
আল্লাহর রাসুলের (সা.) জন্য দরুদ পড়া অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তাআলা কোরআনে তার রাসুলের জন্য সালাত ও সালাম পাঠের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ নবির প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবির জন্য দোয়া করে। হে মুমিনগণ, তোমরাও নবির ওপর দরুদ পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও। (সুরা আহজাব: ৫৬)
অনেকগুলো হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) তার জন্য বেশি বেশি দরুদ পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আমার জন্য একবার দরুদ পড়বে, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। (সহিহ মুসলিম)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বার্ণিত আরেকটি হাদিসে এসেছে, আল্লাহর রাসুলের জন্য দরুদ পাঠকারী কেয়ামতের দিন তার কাছে থাকবে। রাসুল (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন লোকদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই আমার অধিক নিকটতম হবে, যে ব্যক্তি আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করবে। (সুনানে তিরমিজি)
‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ আল্লাহর রাসুলের (সা.) প্রতি সংক্ষীপ্ত দরুদ বা দোয়া যা আমরা তার সম্মানিত নাম উচ্চারণ করলে বা শুনলে পড়ে থাকি। ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ অর্থ হলো, আল্লাহ তার ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। এ ছাড়া অন্যান্য দীর্ঘ দরুদও রয়েছে যেগুলো আমরা প্রতিদিন বারবার পাঠ করতে পারি।
৪. প্রতিদিনের আমল: কোরআন তিলাওয়াত করুন
কোরআন মহান আল্লাহ তাআলার কালাম। মানুষের কাছে পাঠানো আল্লাহর বার্তা। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ বুঝতে, তার ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন গড়তে প্রতিদিন গভীর মনোযোগ দিয়ে চিন্তা ভাবনা করে যতটুকুই সম্ভব হয় কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সুরা সোয়াদ: ২৯) আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তবে কি তারা কোরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহ তালাবদ্ধ? (সুরা মুহাম্মাদ: ২৪)
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা চান আমরা যেন নিয়মিত কোরআনের মর্ম অনুধাবন করে কোরআন পাঠ করি। আল্লাহ কী বলেছেন, কী বুঝিয়েছেন তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করি। কোরআন অর্থ না বুঝে পাঠ করলেও সওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু অর্থ বুঝে কোরআন পাঠের সওয়াব নিঃসন্দেহে অনেক বেশি।
৫. প্রতিদিনের আমল: আল্লাহর জিকির করুন
আল্লাহর স্মরণ সর্বক্ষণ অন্তরে জাগরুক রাখা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি কাজে আল্লাহর বিধান ও সন্তুষ্টির কথা মনে রাখা একজন মুমিনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। জিকির শুধু মুখে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার নাম নয়, আল্লাহর যেকোনো ধরনের আনুগত্য ও ইবাদতও জিকির। দোয়া, ইস্তেগফার, তিলাওয়াত ও দ্বীনি আলোচনাও আল্লাহর জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। একইসাথে আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করা বা আল্লাহর প্রশংসা, পবিত্রতা বর্ণনা, মহত্ত্ব ও বড়ত্বের ঘোষণা মুখে উচ্চারণ করাও আল্লাহর জিকির এবং অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় কর, আমার সাথে কুফরি করো না। (সুরা বাকারা: ১৫২) আরেকটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তুমি নিজ মনে আপন রবকে স্মরণ কর সকাল-সন্ধ্যায় অনুনয়-বিনয় ও ভীতি সহকারে এবং অনুচ্চ স্বরে। আর গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। (সুরা আ’রাফ: ২০৫)
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ থাকা ব্যক্তিদের কঠিন পরিণতি উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত। আর তাকে কেয়ামতের দিন ওঠাব অন্ধ করে। (সুরা ত্বহা: ১২৪)
এ আয়াতগুলোতে ‘আল্লাহর স্মরণ’ অর্থ সামগ্রিকভাবে আল্লাহর আনুগত্য করা, তার বিধান মেনে জীবন পরিচালনা করা। পাশাপাশি মুখে আল্লাহর জিকির করা; তার প্রশংসা, পবিত্রতা বর্ণনা, বড়ত্ব ঘোষণা এবং শুধু তার ইলাহ হওয়ার স্বীকৃতি উচ্চারণ করাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে।
প্রতিদিন আল্লাহর যথাসাধ্য আনুগত্য করার পাশাপাশি মুখেও বেশি বেশি আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করুন। যখনই সুযোগ পান বলুন: ‘সুবাহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’।
৬. প্রতিদিনের আমল: সালাম দিন
ইসলামে সালাম অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসুল (সা.) বেশি বেশি সালাম দিতে উৎসাহিত করে বলেছেন সালাম মুসলমানদের পারস্পরিক সৌহার্দ ও ভালোবাসা বাড়ায়। নবিজি (সা.) বলেন, সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! আপনারা মুমিন না হলে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না আর পরস্পরে সৌহার্দ ও ভালোবাসা না রেখে আপনারা মুমিন হতে পারবেন না। আমি আপনাদের এমন কাজের কথা বলছি যা আপনাদের পারস্পরিক সৌহার্দ বৃদ্ধি করবে, নিজেদের মধ্যে বেশি বেশি সালাম আদান-প্রদান করুন! (সহিহ মুসলিম: ২০৩)
তাই সালাম একজন মুমিনের প্রতিদিনের আমল হওয়া উচিত। কারো সাথে দেখা হলে আগে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। দুইজন মুসলমানের মধ্যে দেখা হলে যে আগে সালাম দেয়, সে বেশি উত্তম, আল্লাহর বেশি নৈকট্যপ্রাপ্ত। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত নবিজি (সা.) বলেন, মানুষের মধ্যে আল্লাহর বেশি নৈকট্যপ্রাপ্ত সে, যে প্রথম সালাম দেয়। (সুনানে আবু দাউদ: ৮৫৮)
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, কোনো এক সাহাবি নবিজিকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! দুইজন ব্যক্তির মধ্যে দেখা হলে তাদের মধ্যে কে আগে সালাম দেবে? নবিজি (সা.) বললেন, যে মহান আল্লাহর বেশি নৈকট্যপ্রাপ্ত, সে আগে সালাম দেবে। (সুনানে তিরমিজি: ৩৬৯৪)
আর কেউ সালাম দিলে তার সালামের উত্তর যথাযথভাবে উচ্চারণ করে এবং সালামদাতাকে শুনিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদেরকে যখন অভিবাদন করা হয়, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম প্রত্যাভিবাদন করবে অথবা তার অনুরূপ করবে। (সুরা নিসা: ৮৬)
এ আয়াতে ‘অভিবাদন’ বলে সালাম উদ্দেশ্য। আয়াতের মর্ম হলো কেউ সালাম দিলে আরও উত্তম শব্দে সালামের জবাব দিতে হবে। অর্থাৎ ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে এবং ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম দিলে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’ বলে সালামের জবাব দিতে হবে।
যদি আরও উত্তম শব্দে জবাব দেওয়া না যায়, তবে অন্তত সালামদাতা যে শব্দে সালাম দিয়েছে, অনুরূপ শব্দে জবাব দিতে হবে। অর্থাৎ ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলে জবাবে অন্তত ‘ওয়ালাকুমুস সালাম’ বলতে হবে।