জুমার দিন সুরা কাহফের তেলাওয়াত ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করার গুরুত্ব অনেক বেশি। এটি সাপ্তাহিক একটি বিশেষ আমল। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও প্রত্যেক জুমার দিন সুরা কাহফ তেলাওয়াত করতে বলেছেন। জুমার দিন সুরা কাহফ তেলাওয়াত করার কারণও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সুরার সঙ্গে দাজ্জালের সম্পর্ক কী? আবার দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার উপায়ই বা কী?
সুরা কাহফের বিশেষ ঘটনা: সুরা কাহফে বিশেষ ৪টি শিক্ষণীয় ও আমল করার ঘটনা উল্লেখ হয়েছে। যা বিবেকবানদের জন্য উত্তম উপদেশ ও দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার উপয়। সুরাটির বিশেষ ঘটনা ও উপদেশ এবং দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার উপায়গুলো তুলে ধরা হলো-
১. আসহাবে কাহফ: গুহাবাসী সাত যুবকের বিশেষ ঘটনা। কাহফ শব্দের অর্থ হলো গুহা। আর আসহাবে কাহফ মানে হলো গুহার অধিবাসী। গুহাবাসী একদল যুবকদের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে এ সুরায়। এ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সুরাটি শুরু করা হয়েছে।
যুবকদের পরিচয় কী?
এ যুবকরা এমন একটি জনপদে বসবাস করত যার অধিবাসী ও শাসকরা ছিল অবিশ্বাসী ও সীমালংঘনকারী। কাজেই যুবকেরা সেই নষ্ট সমাজের ভয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘এদের সাথে আর বসবাস নয়’। তারা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আল্লাহর দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা থেকে উজ্জিবীত হয়ে অত্যাচারী জনপদ থেকে হিজরত করলেন। কোরআনুল কারিমে এ ঘটনা এভাবে শুরু হয়েছে-
أَمْ حَسِبْتَ أَنَّ أَصْحَابَ الْكَهْفِ وَالرَّقِيمِ كَانُوا مِنْ آيَاتِنَا عَجَبًا
আপনি কি ধারণা করেন যে, গুহা ও গর্তের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল? (সুরা কাহফ : আয়াত ৯)
إِذْ أَوَى الْفِتْيَةُ إِلَى الْكَهْفِ فَقَالُوا
‘যখন যুবকরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়; তখন (তারা এভাবে) দোয়া করে-
رَبَّنَا آتِنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا
উচ্চারণ : ‘রাব্বানা আতিনা মিল্লাদুংকা রাহমাতাও ওয়া হাইয়্যিলানা মিন আমরিনা রাশাদা।’
অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! আপনার কাছ থেকে আমাদের রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১০)
فَضَرَبْنَا عَلَى آذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ عَدَدًا
‘তখন আমি কয়েক বছরের জন্যে গুহায় তাদের কানের উপর ঘুমের পর্দা ফেলে দেই।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১১)
ثُمَّ بَعَثْنَاهُمْ لِنَعْلَمَ أَيُّ الْحِزْبَيْنِ أَحْصَى لِمَا لَبِثُوا أَمَدًا
‘তারপর আমি তাদেরকে পুনরুত্থিত করি, একথা জানার জন্যে যে, দুই দলের মধ্যে কোন দল তাদের অবস্থানকাল সম্পর্কে অধিক নির্ণয় করতে পারে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১২)
نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ نَبَأَهُم بِالْحَقِّ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى
‘আপনার কাছে তাদের ইতিহাস-বৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১৩)
وَرَبَطْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَن نَّدْعُوَ مِن دُونِهِ إِلَهًا لَقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا
‘আমি তাদের মনোবল দৃঢ় করেছিলাম, যখন তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর তারা বলল- আমাদের পালনকর্তা আসমান ও জমিনের পালনকর্তা; আমরা কখনো তার পরিবর্তে অন্য কোনো উপাস্যকে আহবান করবো না। যদি করি, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হবে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১৪)
সুরার ৩১নং আয়াত পর্যন্ত আসহাবে কাহফের যুবকদের সুন্দর এ ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। যাতে মুমিন মুসলমানের ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার রসদ রয়েছে। দাজ্জালের ফেতনা শুরু হলে কোরআনের এ শিক্ষায় নিজেকে আত্মরক্ষা করতে পারবে মুমিন।
শিক্ষা : ঈমানের পরীক্ষা
আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহর প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল অগাধ। ঈমানের পরীক্ষায় তারা আল্লাহর কাছে সফল হয়েছিলেন। আর আল্লাহ তাআলা তাদের নিরাপদ গুহায় আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং সূর্যালোক থেকে নিরাপদে রেখেছিলেন। ফলে বহু বছর পর যখন তাদের ঘুম ভাঙলো; তখন তাঁরা দেখলেন সেই অত্যাচারী জনপদের অবিশ্বাসী লোকেরা বিদায় নিয়েছে এবং ভালো লোকদের দ্বারা মন্দ লোকেরা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
২. দুই বাগানের মালিক: কোরআনুল কারিমের এ সুরায় আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয় শিক্ষণীয় ঘটনা এভাবে তুলে ধরেছেন-
وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلًا رَّجُلَيْنِ جَعَلْنَا لِأَحَدِهِمَا جَنَّتَيْنِ مِنْ أَعْنَابٍ وَحَفَفْنَاهُمَا بِنَخْلٍ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمَا زَرْعًا
‘আপনি তাদের কাছে দুই ব্যক্তির উদাহরণ বর্ণনা করুন। আমি তাদের একজনকে দুটি আঙ্গুরের বাগান দিয়েছি এবং এ দুইটিকে খেজুরে গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছি এবং দুয়ের মাঝখানে করেছি শস্যক্ষেত্র।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৩২)
كِلْتَا الْجَنَّتَيْنِ آتَتْ أُكُلَهَا وَلَمْ تَظْلِمْ مِنْهُ شَيْئًا وَفَجَّرْنَا خِلَالَهُمَا نَهَرًا
‘উভয় বাগানই ফলদান করে এবং তা থেকে কিছুই হ্রাস করত না এবং উভয়ের ফাঁকে ফাঁকে আমি নদী প্রবাহিত করেছি।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৩৩)
وَكَانَ لَهُ ثَمَرٌ فَقَالَ لِصَاحِبِهِ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَنَا أَكْثَرُ مِنكَ مَالًا وَأَعَزُّ نَفَرًا
‘সে ফল পেল। তারপর কথা প্রসঙ্গে সঙ্গীকে বলল- আমার ধন-সম্পদ তোমার চেয়ে বেশী এবং জনবলেও আমি বেশি শক্তিশালী।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৩৪)
وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَن تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا
‘নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল- আমার মনে হয় না যে, এ বাগান কখনো ধ্বংস হবে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৩৫)
শিক্ষা : সম্পদের পরীক্ষা
সুরার ৩২-৪৬ আয়াত পর্যন্ত দুনিয়ার ধন-সম্পদ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা শিক্ষণীয় সুন্দর ঘটনাটি তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাদেরকে দুইটি প্রাচুর্যময় সুন্দর বাগান দিয়ে ধন্য করেছিলেন, কিন্তু একজন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে ভুলে গেল; এমনকি পরকালের অস্তিত্ব সম্পর্কে আল্লাহর ওয়াদার উপর সন্দেহ পোষণ করল। কাজেই, এই অকৃতজ্ঞ লোকটির বাগানকে আল্লাহ তাআলা ধ্বংস করে দিলেন। তারপর সে অনুতপ্ত হল, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং তার এই অসময়ের অনুশোচনা কোনো উপকারে আসেনি।
দাজ্জালও এমনিভাবে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থিত হবে। মানুষকে ধন-সম্পদের ফেতনায় ফেলবে। ফলে মানুষ সম্পদের লোভে ঈমানহারা হয়ে যাবে। দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচতে এ ঘটনাও হবে ঈমানদারের জন্য আত্মরক্ষার অন্যতম শিক্ষা।
৩. খিজির ও মুসা আলাইহি সালামের সাক্ষাৎ: হজরত মুসা আলাইহি সালামের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘এই পৃথিবীতে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে?’ তিনি উত্তর বলেছিলেন, ‘আমি’। কিন্তু আল্লাহ তাঁর কাছে উন্মোচন করে দিলেন যে, এমন এক ব্যক্তি আছেন; যাকে আল্লাহ তাঁর চেয়েও বেশি জ্ঞান দান করেছেন। সে ঘটনা এ সুরার ৬০নং আয়াত থেকে শুরু হয়েছে।
হজরত মুসা আলাইহি সালাম সেই ব্যক্তির সঙ্গে ভ্রমণ করলেন, দেখলেন এবং শিখলেন; কীভাবে অনেক সময় আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞানের কারণে এমন অনেক ঘটনা ঘটান যেগুলো আমাদের চোখে খারাপ বলে মনে হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেগুলো মানুষের কল্যাণের জন্যই করা হয়। আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালামের এ ঘটনা এভাবে তুলে ধরেছেন-
فَوَجَدَا عَبْدًا مِّنْ عِبَادِنَا آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِندِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِن لَّدُنَّا عِلْمًا
‘তারপর তাঁরা আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের সাক্ষাত পেলেন, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম ও আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৬৫)
শিক্ষা : জ্ঞানের পরীক্ষা
হজরত খিজির আলাইহিস সালামের সঙ্গে কিছু সময় অতিবাহিত করে হজরত মুসা আলাইহিস সালাম বুঝলেন মহান আল্লাহর এমন অনেক বান্দা আছেন; যাদের মহান আল্লাহ অনেক জ্ঞান দিয়েছেন। দাজ্জালও মানুষের সামনে সমৃদ্ধ অনেক জ্ঞানের কথা তুলে ধরবে। আধিপত্য বিস্তারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করবে। এ ঘটনাও ঈমানদারদের জন্য দাজ্জালের ফেতনা থেকে মুক্তির উৎস, অনুপ্রেরণা ও শিক্ষা।
৪. বাদশাহ যুলকারনাইন: যুলকারনাইন দুনিয়ার একজন ক্ষমতাধর বাদশাহ ছিলেন। তিনি সেই ক্ষমতাধর বাদশাহ; যাকে একই সঙ্গে জ্ঞান এবং ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আর তিনি উভয় দানের শুকরিয়া আদায়ে সবসময় মানুষের উপকারে এবং কল্যাণে ব্যয় করতেন। তিনি জনপদের লোকদের ইয়াজুজ মাজুজ এর সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিলেন আর নির্মাণ করেছিলেন একটি বিশাল প্রাচীর। আল্লাহ তাআলা এ ঘটনা এভাবে তুলে ধরেন-
وَيَسْأَلُونَكَ عَن ذِي الْقَرْنَيْنِ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُم مِّنْهُ ذِكْرًا
‘তারা আপনাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। (আপনি) বলুন, আমি তোমাদের কাছে তাঁর কিছু অবস্থা বর্ণনা করবো।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৮৩)
إِنَّا مَكَّنَّا لَهُ فِي الْأَرْضِ وَآتَيْنَاهُ مِن كُلِّ شَيْءٍ سَبَبًا
‘আমি তাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের কার্যোপকরণ দান করেছিলাম।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৮৪)
এ সুরার ৯৮নং আয়াত পর্যন্ত বাদশাহ জুলকারনাইনের ঘটনার বর্ণনা স্থান পেয়েছে। যেখানে মানুষের কল্যাণে এবং ইয়াজুজ-মাজুজের ঘটনাও তাতে ওঠে এসেছে।
শিক্ষা : ক্ষমতা ও জ্ঞানের পরীক্ষা
পৃথিবীতে এসেই দাজ্জাল তার ক্ষমতা দেখাবে। জ্ঞান-গরিমা দেখাবে। ঈমানদার বান্দার জন্য তখন বাদশাহ যুলকারনাইনের ঘটনা হবে অনুপ্রেরণা। কোনো ক্ষমতার দম্ভ তাদের ঈমানহারা করতে পারবে না। এ কারণেই জুমার দিন মুমিন বান্দা নিজেদের ঈমান দৃঢ় করতে সুরা কাহফ তেলাওয়াত করবেন। সুরা কাহফের মর্মার্থ হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করবেন। আর নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরা কাহফ পড়ে এসব বিষয়গুলো উপলব্দির উপদেশই দিয়েছেন। যাতে দাজ্জালের আবির্ভাবের কঠিন সময়ে নিজেদের ঈমানের ওপর অটল রাখতে পারেন।
উল্লেখ্য ৪টি বিশেষ ঘটনা ছাড়াও কিছু বিশেষ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে সুরাটিতে। যাতে হজরত আদমকে সেজদা এবং ইবলিশের অস্বীকৃতির কথা। সুরাটির মাঝামাঝিতে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বিতাড়িত ইবলিসের কথা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاء مِن دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا
‘যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সেজদা কর, তখন সবাই সেজদা করলো ইবলিস ছাড়া। সে ছিল জিনদের একজন। সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করলো। অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। এটা জালেমদের জন্যে খুবই নিকৃষ্ট বিনিময়।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৫০)
সুরা কাহফের সঙ্গে দাজ্জালের সম্পর্ক: দাজ্জালের আবির্ভাব কেয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার অন্যতম বড় একটি লক্ষণ। দাজ্জালও ৪টি বিশেষ ফেতনা নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থিত হবে। যে বিষয়গুলো সুরা কাহফে উল্লেখিত হয়েছে। আর তাহলো-
১. দাজ্জালের ওপর ঈমান আনা: দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করেই মানুষকে আদেশ করবে, তারা যেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার ইবাদত করে। তাকে প্রভু বলে মেনে নেয়। ঈমানের উপর এটি অনেক বড় পরীক্ষা। যা আসহাবে কাহফের সদস্যরা ঈমানের তাগিদে নিজ জনপদ ছেড়ে হিজরত করেছে। তারপরও ঈমান থেকে একটু সরেননি।
২. সম্পদের আধিপত্য: দাজ্জাল মানুষের সামনে সম্পদের আধিপত্য দেখাবে। মানুষকে সম্পদের ওপর পরীক্ষায় ফেলবে। সে মানুষকে সম্পদের লোভ দেখাবে। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে দুই বাগানের মালিকের ঘটনা তুলে ধরেছেন। যাতে দাজ্জালের সম্পদের লোভে মানুষ ঈমানহারা না হয়।
৩. দাজ্জাল মানুষকে ধাঁধায় ফেলবে: দাজ্জাল নিজেকে অনেক বড় জ্ঞানী হিসেবে মানুষের সামনে প্রকাশ করবে। এ কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও হজরত খিজির আলাইহিস সালামের জ্ঞানের বিবরণ তুলে ধরেছেন। দাজ্জাল মানুষের সামনে অনেক সংবাদ প্রকাশ করবে। তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে কেউ যেন ঈমানহারা না হয়; তাই আল্লাহ তাআলা এ সুরায় জ্ঞানের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
৪. দাজ্জালের নিয়ন্ত্রণে থাকবে পৃথিবী: দাজ্জাল যখন আত্মপ্রকাশ করবে তখন পৃথিবীর এক বিশাল অংশ তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তার ক্ষমতা ছড়িয়ে পড়বে সবদিকে। এজন্য আল্লাহ তাআলা বাদশাহ জুলকারনাইনের ক্ষমতার বিবরণ তুলে ধরেছেন। যাতে ঈমানদাররা ক্ষমতার কাছে নিজেদের ঈমান না হারিয়ে বসেন।
তাই নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন মুসলমানকে অনুপ্রেরণা নিতে প্রত্যেক জুমার দিন সুরা কাহফ পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন।
দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচতে করণীয়: দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার অন্যতম উপায় হলো সুরা কাহফের আমল। সুরা কাহফ তেলাওয়াত ও এর মর্মার্থ ভালোভাবে উপলব্দি করে সে অনুযায়ী আমল করা। তবেই দাজ্জালের ভয়াবহ ফেতনা থেকে মুক্ত থাকা যাবে। বিশেষ করণীয় হলো-
১. ভালো মানুষের সুসম্পর্ক রাখা: আল্লাহ তাআলা সুরা কাহফের ২৮নং আয়াতে দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচতে প্রথম উপায় হলো সৎ মানুষের সংস্পর্শে থাকা। এ কথার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন এভাবে-
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَن ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا
আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি; যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার অনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ২৮)
২. দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করা: দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার দ্বিতীয় উপায় হলো দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতার বিষয়গুলো হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করা। যাতে দুনিয়ার কোনো বাস্তবতায় মানুষকে ঈমানহারা করতে না পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاء أَنزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاء فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ فَأَصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُّقْتَدِرًا
তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা নির্গত হয়; অতঃপর তা এমন শুস্ক চুর্ণ-বিচুর ্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এ সবকিছুর উপর শক্তিমান।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৪৫)
৩. ধৈর্য্যশীল হওয়া: দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার তৃতীয় উপায় হলো ধের্যশীল থাকা। কেননা কোরআনুল কারিমে হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও হজরত খিজির আলাইহিস সালামের জ্ঞানের এ ঘটনায় ধৈর্যের বিষয়টি ওঠে এসেছে। জ্ঞানী ব্যক্তিরা ধৈর্যের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করে থাকেন। এ ধৈর্যের শিক্ষায় মুমিন দুজ্জালের আক্রমণ থেকে মুক্তি পাবে। বিষয়টি বুঝতে পুরো ঘটনাটি পড়া আবশ্যক হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
قَالَ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللَّهُ صَابِرًا وَلَا أَعْصِي لَكَ أَمْرًا
‘মুসা বললেন, আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোনো আদেশ অমান্য করব না।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৬৯)
৪. বেশি বেশি নেক আমল করা: দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে দুনিয়ায় বেশি বেশি সৎ কাজ সম্পাদন করা। যা বাদশাহ জুলকারনাইন করেছেন। অত্যাচারী ইয়াজুজ-মাজুজের নির্যাতন থেকে জনপদের মানুষকে নিরাপত্তা দান করতে তিনি তৈরি করেছিলেন বিশাল প্রাচীর। আল্লাহ তাআলা বলেন-
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
'বলুন! আমি ও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১১০)
৫. আল্লাহর দিকে ডাকা: দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার পঞ্চম উপায় হলো মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। সুরা কাহফের শুরু দিকে মহান আল্লাহ এমনটি ইঙ্গিত দিয়েছেন এভাবে-
وَاتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِن كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَلَن تَجِدَ مِن دُونِهِ مُلْتَحَدًا
আপনার প্রতি আপনার পালনকর্তার যে, কিতাব নাজিল হয়েছে, তা পাঠ করুন। তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নাই। তাঁকে ব্যতিত আপনি কখনই কোনো আশ্রয় স্থল পাবেন না।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ২৭)
৬. পরকালকে বেশি বেশি স্মরণ রাখা: দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচতে পরকালের কথা বেশি স্মরণ করে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা। আর তাতে এ ভয়াবহ ফেতনা থেকে মুক্তি পাবেন মুমিন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَيَوْمَ نُسَيِّرُ الْجِبَالَ وَتَرَى الْأَرْضَ بَارِزَةً وَحَشَرْنَاهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا - وَعُرِضُوا عَلَى رَبِّكَ صَفًّا لَّقَدْ جِئْتُمُونَا كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ بَلْ زَعَمْتُمْ أَلَّن نَّجْعَلَ لَكُم مَّوْعِدًا - وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا
যেদিন আমি পর্বতসমূহকে পরিচালনা করব এবং আপনি পৃথিবীকে দেখবেন একটি উম্মুক্ত প্রান্তর এবং আমি মানুষকে একত্রিত করব অতঃপর তাদের কাউকে ছাড়ব না। তারা আপনার পালনকর্তার সামনে পেশ হবে সারিবদ্ধ ভাবে এবং বলা হবে- তোমরা আমার কাছে এসে গেছ; যেমন তোমাদেরকে প্রথম বার সৃষ্টি করেছিলাম। না, তোমরা তো বলতে যে, আমি তোমাদের জন্যে কোন প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করব না। আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস ্ত দেখবেন। তারা বলবেঃ হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না। (সুরা কাহাফ, আয়াত ৪৭-৪৯)
সুরা কাহফ অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আমলি সুরা। সুন্নাতের অনুসরণে এ সুরার তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন মুমিন মুসলমানকে দাজ্জালের ভয়াবহ ফেতনা থেকে মুক্ত করবে।
দাজ্জালের ফেতনামুক্ত থাকার আমল: মুমিন মুসলমানের উচিত, সুরা কাহফ তেলাওয়াত করা। কেননা হাদিসের একাধিক বর্ণনা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
১. ‘যে ব্যক্তি সুরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্ত করে, তাকে দাজ্জালের ফেতনা থেকে রক্ষা করা হয়’ (মুসনাদে আহমদ)
২. ‘যে ব্যক্তি সুরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্ত করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (মুসলিম)
দাজ্জালের ফেতনামুক্ত থাকার দোয়া: নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে কোরআন মাজিদের সুরা শেখাতেন ঠিক তেমনিভাবে দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার জন্য এ দোয়াটিও শেখাতেন। তাহলো-
اَللَّهُمَّ اِنِّي اَعُوْذُبِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيْح الدَّجَّال
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আ’উজুবিকা মিন ফিতনাতি মাসিহুদ দাজ্জাল।’ (বুখারি)
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে অভিশপ্ত দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই।’
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জুমআর দিন সুরা কাহফের আমল, তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন করার মাধ্যমে হাদিসে বর্ণিত ফজিলত ও উপকারিতা অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
রাজশাহীর সময়/এমজেড