২০১৯ সালে তিনটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) বিভিন্ন পদে ১৩৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের ৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২তম সিন্ডিকেট সভায় ওই নিয়োগ পাস হয়। কিন্তু এখনো নিয়োগের কার্যবিবরণী (রেজুলেশন) করা হয়নি।এক বছর পূর্ণ হতে চললেও ওই নিয়োগের কার্যবিবরণী লিপিবব্ধ করার কোনো উদ্যোগই এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যবিবরণী করার নিয়ম থাকলেও বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে।সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, নিয়োগ নিয়ে তুমুল সমালোচনা ও চলমান বিতর্ক সামাল দিতেই ওই নিয়োগের কার্যবিবরণী লিপিবব্ধ করতে অনীহা ও সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। অথচ এরপর তিনটি জরুরী সি-িকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রুয়েটের বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগ নিয়ে ভিসি প্রফেসর রফিকুল ইসলাম সেখের বিরুদ্ধে উঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সিদ্ধান্ত নিলেও তা এখনো শুরুই হয়নি। সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক মাস অতিবাহিত হলেও তদন্ত কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
২০১৮ সালের ৩০ জুলাই পরবর্তী চার বছরের জন্য রুয়েটেরভিসি হিসেবে নিয়োগ পান প্রফেসর রফিকুল ইসলাম সেখ। চলতি বছরের (২০২২) জুলাইয়ে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সে হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হতেএখনো মাস তিনেক বাকি। এরই মধ্যে রুয়েটে বিধি বহির্ভূত, স্বজনপ্রীতি ও বিতর্কিত জনবল নিয়োগের জের ধরে ভিসির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইছে।এতে ভিসির আত্নীয় ও কাছের লোক হিসেবে পরিচিত প্রায় ডজনখানেক লোক বিভিন্ন পদে নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।এ নিয়ে বিতর্ক ও তুমুল আলোচনা-সমালোচনার রেশ না কাটতেই আবারো আরো কিছু জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি সি-িকেট নিজেদের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিতে জনবল নিয়োগের জন্যে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতেও অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন বলে চাকরি প্রার্থী ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
এ নিয়ে গত ২ মার্চ প্রথমে নয়া দিগন্তে ‘বিধিবহির্ভূতভাবে জনবল নিয়োগ চেষ্টার অভিযোগ রুয়েট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে করে রুয়েট প্রশাসনে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। পরে ৩০ মার্চনয়া দিগন্তে‘বিদায়ের আগে রুয়েট ভিসির বিরুদ্ধেসমালোচনার ঝড়’ শিরোনামে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরই মাঝে আরো কিছু গণমাধ্যমে বিধি বহির্ভূতভাবে ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে জনবল নিয়োগ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়।এতে বলা হয়, যোগ্য ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের শ্যালক, দুই ভাই, স্ত্রীর ফুফাতো ভাই, চাচাতো বোন, গৃহকর্মী ও তাঁর স্বামীকে কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন ভিসি। এরই প্রেক্ষিতেরুয়েটের বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ভিসি রফিকুল ইসলাম সেখের বিরুদ্ধে উঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গত ২০ মার্চ জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির ১৫তম বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া রুয়েটের ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কমিটির সদস্যরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিতে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রুয়েটের রেজিস্ট্রার দফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে তিনটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রুয়েটে বিভিন্ন পদে ১৩৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছরের (২০২১) ৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২তম সিন্ডিকেট সভায় ওই নিয়োগ পাস হয়। কিন্তু এখনো নিয়োগের কার্যবিবরণী লিপিবব্ধ করা হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যবিবরণী লিপিবব্ধ করার নিয়ম থাকলেও বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, নিয়োগ নিয়ে তুমুল সমালোচনা ও চলমান বিতর্ক সামাল দিতেই ওই নিয়োগের কার্যবিবরণী লিপিবব্ধ করতে অনীহা ও অযৌক্তিকভাবে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। অথচ এরপর তিনটি জরুরী সি-িকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর আলমগীর হোসেন বলেন, সি-িকেটে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তার কার্যবিবরণী দ্রুত সময়ের মধ্যে লিপিবব্ধ করার নিয়ম রয়েছে। যদিও আইনে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তিনি বলেন, কার্যবিবরণী লিপিবব্ধ করার আগে তার সিদ্ধান্তসমূহ সি-িকেটের সদস্যদের কাছে পাঠাতে হবে। এতে সদস্যদের কারো কোনো সংশোধনী বা আপত্তি থাকলে তা ঠিক করে নিয়ে লিপিবব্ধ করতে হবে। আর কোনো আপত্তি না থাকলে সঠিক বলে ধরে নিতে হবে। সাধারণত ১৫ দিন থেকে এক মাসের মধ্যেই কার্যবিবরণী লিপিবব্ধ করার রেওয়াজ বা নিয়ম রয়েছে।
রুয়েট ভিসির বিরুদ্ধে বিধি বহির্ভূত, স্বজনপ্রীতি ও বিতর্কিত জনবল নিয়োগ নিয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর দিল আফরোজ বলেন, এখনো তদন্ত শুরু হয়নি। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি ইউজিসিকে দিতে হবে। তার পরই তদন্ত কার্যক্রম শুরু হবে। তবে নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের প্রেক্ষিতে রুয়েট ভিসিকে ইউজিসির পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। রুয়েট ভিসি এর জবাব দিয়েছেন কিনা তা খোঁজ না নিয়ে তিনি বলতে পারছেন না।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রুয়েটের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্ভবত ইউজিসির ওই চিঠির জবাব ভিসি স্যার দিয়েছেন।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা) এবং রুয়েটের সি-িকেট সদস্য একেএম আফতাব হোসেন প্রামাণিক বলেন, রুয়েটেবিধি বহির্ভূত ও স্বজনপ্রীতির জনবল নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরে এখনো চিঠি আসেনি। সেখান থেকে চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে মোবাইলে রুয়েটের ভিসি প্রফেসর রফিকুল ইসলাম সেখের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে তাঁর পিএস মাহবুব সালাম সেতুর সাথে যোগাযোগ করা হলেও ভিসির সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এরআগে সব অভিযোগ অস্বীকার করে ভিসি জানিয়েছিলেন, জনবল নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। ভিসি দাবি করেন, তিনি নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন না। যোগ্যতা অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়ে তারা চাকরি পেয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে মোবাইলে রুয়েটেররেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. সেলিম হোসেনের সাথে মোবাইলে যোগোযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে এরআগে প্রফেসর ড. সেলিম হোসেন জানিয়েছিলেন, নিয়োগে কোনো ধরণের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে,বিধিবহির্ভূত, স্বজনপ্রীতি ও বিতর্কিত জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভবে যারা সম্পৃক্ত বলে ক্যম্পাসে জোর গুঞ্জন রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- মহানগর আ’লীগের এক নেতার ছেলে (রুয়েটে কর্মরত), একাধিক সহকারী প্রকৌশলী, একাধিক শিক্ষক, ভিসি সমর্থিত কর্মকর্তা সমিতির একাধিক নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা সহ আরো দুই থেকে তিনজন।তারা সবাই ভিসির কাছের লোক হিসেবে পরিচিত।