২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১১:৪৪:৩৩ পূর্বাহ্ন


কোরআন তেলাওয়াত ও নামাজ কি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জিকির?
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৪-২০২২
কোরআন তেলাওয়াত ও নামাজ কি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জিকির? ফাইল ফটো


মহান আল্লাহ মানুষকে এ মর্মে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমাদের প্রতি যে কিতাব নাজিল করা হয়েছে, তা থেকে তেলাওয়াত করো এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করো। যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, এ নামাজ তাদের অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। চমৎকার এ ঘোষণায় হাফেজে কোরআনগণ ১৮ তারাবির নামাজ শুরু করবেন। ধারাবাহিকভাবে সুরা আনকাবুতের বাকি অংশসহ সুরা রূম, সুরা লোকমান, সুরা সাজদাহ এবং সুরা আহযাবের ৩০তম আয়াত পর্যন্ত পড়বেন। শেষ হবে ২১তম পাড়ার তেলাওয়াত। তারাবির প্রথম রাকাতে হাফেজে কোরআনদের কণ্ঠে শুরুতেই ধ্বনিত হয়-

 اُتۡلُ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ ؕ اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لَذِکۡرُ اللّٰهِ اَکۡبَرُ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ مَا تَصۡنَعُوۡنَ

'তোমার প্রতি যে কিতাব অহি করা হয়েছে, তা থেকে তেলাওয়াত করো এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করো। নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা করো।' (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৪৫)

আল্লাহ ছাড়া এমন সুন্দর ঘোষণা ও উপদেশ মানুষকে আর কে দিতে পারে? তিনিই মহান; তিনিই মানুষের একমাত্র মুক্তিদাতা। সঠিক পথ তিনিই মানুষকে দেখাতে পারেন। কত চমৎকার উপদেশ তিনি দিলেন। এ উপদেশে তিনি কী বুঝিয়েছেন?

এ আয়াতে যদিও দেখা যায় যে, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে সব মুসলিমদেরকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এতে দুটি অংশ আছে। এক : কোরআন তেলাওয়াত; দুই : নামাজ প্রতিষ্ঠা করা।

কারণ এ দুইটি জিনিসই মুমিনকে এমন সুগঠিত সুন্দর অনুপম চরিত্র ও উন্নত তুলাহীন যোগ্যতার অধিকারী করে দেবে; যার সাহায্যে সে অন্যায়ের প্রবল বন্যা এবং দুস্কৃতির ভয়াবহ মহামারির মোকাবিলায় সঠিক পথে থাকতে পারবে।

প্রথম কাজ  : কোরআন তেলাওয়াত

আল্লাহর প্রকৃত বান্দারাই কোরআন তেলাওয়াতের শক্তি ও হিম্মত পেয়ে থাকে। কোরআন তেলাওয়াতের এ শক্তি মানুষ তখনই অর্জন করতে পারে যখন সে কোরআনের শুধুমাত্র শব্দগুলো পাঠ করেই থেকে যায় না বরং তার শিক্ষাগুলোও সঠিকভাবে অনুধাবন করে হৃদয়ের প্রতিটি স্থানে সেগুলোকে সঞ্চারিত করে যেতে থাকে।

আবার যে তেলাওয়াতের পরে মানুষের মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা ও চরিত্র-কর্মনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসে না বরং কোরআন পড়ার পরও কোরআন যা নিষেধ করে মানুষ তা সব করে যেতে থাকে; তাহলে বুঝতে হবে এটি কোনো মুমিনের কোরআন তেলাওয়াত হতে পারে না।

মূলতঃ কোরআনের হারামকৃত জিনিসকে যে হালাল করে নিয়েছে; যে কোরআনের প্রতি ঈমানই আনেনি। এ অবস্থাটিকে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ছোট্ট বাক্যের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, 'কোরআন তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ।' (মুসলিম)

দ্বিতীয় কাজ : নামাজ প্রতিষ্ঠা করা

কোরআন তেলাওয়াতের পর দ্বিতীয় যে কাজটির প্রতি উম্মতকে নিয়োজিত থাকার নির্দেশ এখানে দেওয়া হয়েছে তাহলো- 'নামাজ প্রতিষ্ঠা করা'৷ নামাজকে অন্যান্য ফরজ কাজ থেকে পৃথক করার এই রহস্যও বর্ণিত হয়েছে এভাবে- নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং দ্বীনের স্তম্ভ। এর উপকারিতা এই যে, 'যে ব্যক্তি নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, নামাজ তাকে অশ্লীল ও গৰ্হিত কাজ থেকে বিরত রাখবে।' (ইবনে কাসির)

এ আয়াতে উল্লেখিত 'ফাহশা’ শব্দের অর্থ এমন সুস্পষ্ট মন্দ কাজ, যাকে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই মন্দ মনে করে; যেমন- ব্যভিচার, অন্যায় হত্যা, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি। পক্ষান্তরে ‘মুনকার’ এমন কথা ও কাজকে বলা হয়, যার হারাম ও অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে শরিয়ত বিশারদগণ একমত।' (বাগভি, ফাতহুল কাদির)

এই ‘ফাহশা’ ও ‘মুনকার’ শব্দ দুটির মধ্যে যাবতীয় অপরাধ এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গুনাহ প্রবেশ করেছে। আর এগুলো অবশ্যই মন্দ এবং সৎকর্মের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। নামাজই এ সব বাধা দূরীভূত করে দেয়।

প্রশ্ন আসতে পারে

অনেক মানুষকে নামাজি দেখা যাওয়া সত্বেও তারা বড় বড় গুনাহে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। এটা আলোচ্য আয়াতের পরিপন্থী নয় কি? এরও কয়েকটি উত্তর দেওয়া হয়েছে। তাহলো-

১. প্রকৃত নামাজ আদায়কারীকে এ নামাজ অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখবে। হজরত হাসান ও কাতাদাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যার নামাজ তাকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখল না সে নামাজ দ্বারা আল্লাহ থেকে দূরেই রয়ে গেল।' (তাবারি)

২. যারা নিয়মিত নামাজ আদায় করবে, তাদের এ অবস্থাটি তৈরি হবে। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'এক লোক নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, এক লোক রাতে নামাজ আদায় করে, আর সকাল হলে চুরি করে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অচিরেই তার নামাজ তাকে তা থেকে নিষেধ করবে।' (মুসনাদে আহমাদ) 

মনে রাখতে হবে

আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। তা হোক কোরআন তেলাওয়াত আর হোক নামাজ। আল্লাহর স্মরণ যে সর্বশ্রেষ্ঠ হাদিসের অনেক বর্ণনায় তা ওঠে এসেছে। তাছাড়া জিকিরের গুরুত্বও অনেক বেশি। যেমন-

এক. আল্লাহর জিকির সবচেয়ে বড় ইবাদত। আর নামাজ বড় ইবাদাত হওয়ার কারণ হচ্ছে, এতে আল্লাহর জিকির থাকে। সুতরাং যে নামাজে জিকির বেশি সে নামাজ বেশি উত্তম।' (ইবনে কাসির)

দুই. আল্লাহর স্মরণ অনেক বড় জিনিস, সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। মানুষের কোনো কাজ এর চেয়ে বেশি বড় নয়।' (তাবারি)

তিন. তোমার আল্লাহকে স্মরণ করার চেয়ে আল্লাহ কর্তৃক তোমাকে স্মরণ করা অনেক বেশি বড় জিনিস।' (তাবারি)

এ কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমের অন্য আয়াতে এ মর্মে ঘোষণা করেছেন, 'তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদের স্মরণ করবো।' (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫২)

কাজেই বান্দা যখন নামাজে আল্লাহকে স্মরণ করবে। তখন অবশ্যই আল্লাহও তাকে স্মরণ করবেন। আর বান্দার আল্লাহকে স্মরণ করার তুলনায় আল্লাহর বান্দাকে স্মরণ করা অনেক বেশি মর্যাদা ও সম্মানের। বান্দা যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ ওয়াদা অনুযায়ী স্মরণকারী বান্দাকে ফেরেশতাদের সমাবেশেও স্মরণ করেন। আল্লাহর এ স্মরণ ইবাদতকারী বান্দার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত।

সুরা আনকাবুত : আয়াত ৪৫-৬৯

আজকের তারাবিতে সুরা আনকাবুতের শেষাংশ তেলাওয়াত করা হবে। প্রথম আয়াতে কোরআন তেলাওয়াত ও নামাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ তথা তার জিকির করার নির্দেশ রয়েছে। এ সুরায় আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠ মুজিজার বর্ণনাও দিয়েছেন। তাহলো- নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরক্ষর হওয়া। অথচ তাঁর প্রতি নাজিল হয়েছে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব- কোরআনুল কারিম। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ مَا کُنۡتَ تَتۡلُوۡا مِنۡ قَبۡلِهٖ مِنۡ کِتٰبٍ وَّ لَا تَخُطُّهٗ بِیَمِیۡنِکَ اِذًا لَّارۡتَابَ الۡمُبۡطِلُوۡنَ -  بَلۡ هُوَ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ فِیۡ صُدُوۡرِ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ ؕ وَ مَا یَجۡحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا الظّٰلِمُوۡنَ

‘আপনি তো এর আগে কোনো কিতাব পাঠ করেননি এবং স্বীয় হাত দ্বারা কোনো কিতাব লেখেননি; তাহলে মিথ্যাবাদীরা অবশ্যই সন্দেহ পোষণ করত। বরং যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে ইহা (কোরআন) তো সুস্পষ্ট আয়াত। কেবল বে-ইনসাফরাই আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৪৮-৪৯)

নবিজী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো লেখাই দেখে দেখে পড়তে পারতেন না। কোনো লেখা লিখতেও সক্ষম ছিলেন। আর এ নিরক্ষর অবস্থায়ই নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের প্রথম ৪০টি বছর পণ্ডিত মক্কাবাসীর সামনে আল্লাহর কোরআন নিয়ে দাপটের সঙ্গে দ্বীনের দাওয়াত ও সংগ্রাম করেই অতিবাহিত করেন।

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো আসমানি কিতাবের অনুসারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেননি। তাদের কাছ থেকে আসমানি কিতাবের কোনো বর্ণনাও শোনেননি। আর তৎকালীন সময়ে মক্কায় কোনো আসমানি কিতাবের অনুসারী পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গও ছিল না।

অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০ বছরে উপনীত হওয়ার পর তাঁর মুখ থেকে এমন শব্দমালা উচ্চারিত হতে লাগলো, যা বিষয়বস্তু ও অর্থের দিক থেকে যেমন ছিল মুজেজাস্বরূপ এবং ভাষাগত শাব্দিক বিশুদ্ধতা ও ভাষার সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়।

নবিজীর শ্রেষ্ঠ মুজেজা

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরক্ষরতাই ছিল তৎকালীন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ মুজেজা। যা মক্কার পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য ছিল এক মহা চিন্তা ও শিক্ষার বিষয়। আর এটা ছিল তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাতের সত্যতার ওপর বিশ্বাস স্থাপনের এক মহা প্রমাণ। এ কুরআনই বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اَوَ لَمۡ یَکۡفِهِمۡ اَنَّاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ یُتۡلٰی عَلَیۡهِمۡ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَرَحۡمَۃً وَّ ذِکۡرٰی لِقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ

'এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্য রয়েছে রহমত ও উপদেশ।' (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৫১)

আবার ঈমানদারদের প্রতি ইবাদত করার ঘোষণা ও সুনিশ্চিত মৃত্যুর ঘোষণা এসেছে। যেন তারা আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করে। কেননা তাদের সবাইকে একদিন ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন-

 یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ اَرۡضِیۡ وَاسِعَۃٌ فَاِیَّایَ فَاعۡبُدُوۡنِ -  کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ۟ ثُمَّ اِلَیۡنَا تُرۡجَعُوۡنَ

'হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ, আমার পৃথিবী প্রশস্ত। অতএব তোমরা আমারই এবাদত কর। জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।' (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৫৬-৫৭)

সুরা রূম : আয়াত ০১-৬০

মক্কায় অবতীর্ণ ৬০ আয়াত বিশিষ্ট সুরায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তকেন্দ্রিক আলোচনা ওঠে এসেছে। যাতে নবুয়তের সত্যতার দলিল প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং এ সম্পর্কে কুরআনের আয়াতও নাজিল হয়েছিল। অবশেষে এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে এ সুরায়। সুরাটিতে দুনিয়ার জীবনের ব্যাপ্তি নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন- ‘তিনি যাকে ইচ্ছা বিজয় দান করেন আবার সেই বিজয়ীকে পরাজিতও করেন।’ এতেই প্রমাণিত হয় যে, কারো বিজয় তার সত্যতার প্রমাণ নয়।

দুনিয়ার জীবনের সম্মান-মর্যাদা, অপমান সবাই আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। এরপরও অবিশ্বাসী সম্প্রদায় মুসলমানদের সাময়িক সময়ের দারিদ্র্যতার জন্য হেয় প্রতিপন্ন করে। যা সবিস্তার আলোচিত হয়েছে সুরা রূমে। এ সুরার আলোচ্য বিষয়গুলো হলো-

বৈবাহিক জীবনে শান্তির জন্য পারস্পরিক সম্প্রীতি জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন-

 وَ مِنۡ اٰیٰتِهٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡهَا وَ جَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ

'আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর আর ও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।' ' (সুরা রূম : আয়াত ২১)

ফিতরাত সম্পর্কিত আলোচনা। আল্লাহ বলেন-

فَاَقِمۡ وَجۡهَکَ لِلدِّیۡنِ حَنِیۡفًا ؕ فِطۡرَتَ اللّٰهِ الَّتِیۡ فَطَرَ النَّاسَ عَلَیۡهَا ؕ لَا تَبۡدِیۡلَ لِخَلۡقِ اللّٰهِ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ٭ۙ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ مُنِیۡبِیۡنَ اِلَیۡهِ وَ اتَّقُوۡهُ وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ لَا تَکُوۡنُوۡا مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ

'তুমি একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহর ফিতরাত বা প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। সবাই তাঁর অভিমুখী হও এবং ভয় কর, নামায কায়েম কর এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।' (সুরা রূম : আয়াত ৩০-৩১)

বাতিলপন্থিদের ভ্রান্ত পরিবেশ থেকে দূরে থাকা প্রসঙ্গ। আল্লাহ বলেন-

 فَاِنَّکَ لَا تُسۡمِعُ الۡمَوۡتٰی وَ لَا تُسۡمِعُ الصُّمَّ الدُّعَآءَ اِذَا وَلَّوۡا مُدۡبِرِیۡنَ -  وَ مَاۤ اَنۡتَ بِهٰدِ الۡعُمۡیِ عَنۡ ضَلٰلَتِهِمۡ ؕ اِنۡ تُسۡمِعُ اِلَّا مَنۡ یُّؤۡمِنُ بِاٰیٰتِنَا فَهُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ

'অতএব, আপনি মৃতদেরকে শোনাতে পারবেন না এবং বধিরকেও আহবান শোনাতে পারবেন না, যখন তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। আপনি অন্ধদেরও তাদের পথভ্রষ্টতা থেকে পথ দেখাতে পারবেন না। আপনি কেবল তাদেরই শোনাতে পারবেন, যারা আমার আয়াতসমূহে বিশ্বাস করে। কারণ তারা মুসলমান।' (সুরা রূম : আয়াত ৫২-৫৩)

আয়াতে এমন সব লোককে মৃত বলা হয়েছে, যাদের বিবেক মরে গেছে, যাদের মধ্যে নৈতিক জীবনের ছিটেফোটাও নেই এবং যাদের আপন প্রবৃত্তির দাসত্ব, জিদ ও একগুয়েমি সেই মানবীয় গুণাবলীর অবসান ঘটিয়েছে; যা মানুষকে হক কথা বুঝার ও গ্রহণ করার যোগ্য করে তোলে।

হজরত কাতাদাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এ উদাহরণটি আল্লাহ তাআলা কাফেরদের উদ্দেশ্য করে পেশ করেছেন। যেভাবে মৃতরা আহবান শুনতে পায় না, তেমনি কাফেররাও শুনতে পায় না। অনুরূপভাবে যেভাবে কোনো বধির ব্যক্তি পেছনে ফিরে চলে গেলে তাকে পেছন থেকে ডাকলে শুনতে পায় না, তেমনি কাফের কিছুই শুনতে পায় না, আর শুনলেও সেটা দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। (তাবারি)

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর যুদ্ধের পর বদরের কুপের পাশে যেখানে কাফেরদের লাশ রাখা ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে কাফেরদের সম্বোধন করে বললেন, তোমাদের মাবুদরা তোমাদেরকে যা দেওয়ার ওয়াদা করেছে তা কি তোমরা পেয়েছ? তারপর তিনি বললেন, তারা এখন আমি যা বলছি তা শুনছে। তারপর এ হাদিসটি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জানানো হলে তিনি বললেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো এটাই বলেছেন যে, তারা এখন অবশ্যই জানছে যে, আমি তাদেরকে যা বলেছি তা-ই যথাযথ। তারপর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন৷' (বুখারি)

> পরকালের (হাশরে) আল্লাহর সামনে মিথ্যা বলা প্রসঙ্গ। আল্লাহ বলেন-

 وَ یَوۡمَ تَقُوۡمُ السَّاعَۃُ یُقۡسِمُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ ۬ۙ مَا لَبِثُوۡا غَیۡرَ سَاعَۃٍ ؕ کَذٰلِکَ کَانُوۡا یُؤۡفَکُوۡنَ -  وَ قَالَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ وَ الۡاِیۡمَانَ لَقَدۡ لَبِثۡتُمۡ فِیۡ کِتٰبِ اللّٰهِ اِلٰی یَوۡمِ الۡبَعۡثِ ۫ فَهٰذَا یَوۡمُ الۡبَعۡثِ وَ لٰکِنَّکُمۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ

'যেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা কসম খেয়ে বলবে যে, এক মুহুর্তেরও বেশী অবস্থান করিনি। এমনিভাবে তারা সত্যবিমুখ হত। যাদের জ্ঞান ও ঈমান দেয়া হয়েছে, তারা বলবে আমরা আল্লাহর কিতাব মতে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবস্থান করেছি। এটাই পুনরুত্থান দিবস, কিন্তু তোমরা তা জানতে না।' (সুরা রূম : আয়াত ৫৫-৫৬)

হাশরে ময়দানে কাফেররা কসম খেয়ে এই মিথ্যা কথা বলবে, 'আমরা দুনিয়াতে অথবা কবরে এক মুহুর্তের বেশি থাকিনি। অন্য এক আয়াতে মুশরিকদের এই উক্তি বর্ণিত আছে, 'তারা কসম খেয়ে বলবে আমরা মুশরিক ছিলাম না।' (সুরা আনআম : আয়াত ২৩)

হাশরের ময়দানে রাব্বুল আলমিনের আদালত কায়েম হবে। তিনি সবাইকে স্বাধীনতা দেবেন। তারা সত্য কিংবা মিথ্যা যে কোনো বিবৃতি দিতে পারবে। কেননা, রাব্বুল আলমিনের ব্যক্তিগত জ্ঞানও পূর্ণমাত্রায় আছে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্যে তিনি তাদের স্বীকারোক্তি করা না করার মুখাপেক্ষী নন।

মানুষ যখন মিথ্যা বলবে, তখন তার মুখ মোহরাঙ্কিত করে দেয়া হবে এবং তার হাত-পা ও চামড়া থেকে সাক্ষ্য নেওয়া হবে। এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা বিবৃত করে দেবে। এরপর আর কোনো প্রমাণ আবশ্যক হবে না। আলোচ্য আয়াতের অর্থ তাই।

কোরআনের অন্যান্য আয়াত থেকে জানা যায় যে, হাশরের মাঠে বিভিন্ন অবস্থানস্থল হবে এবং প্রত্যেক অবস্থানস্থলের অবস্থা ভিন্নরূপ হবে। এক অবস্থানস্থলে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারও কথা বলার অধিকার থাকবে না। যাকে অনুমতি দেওয়া হবে, সে কেবল সত্য ও নির্ভুল কথা বলতে পারবে মিথ্যা বলার সামৰ্থ্য থাকবে না। যেমন এরশাদ হয়েছে- 'যখন সেদিন আসবে তখন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না।' (সুরা হুদ : আয়াত ১০৫)

এর বিপরীতে হাদিসের বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে, 'কবরে যখন কাফেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তোমার পালনকর্তা কে এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে? তখন সে বলবে, ‘হায়, হায়, আমি কিছুই জানি না।' (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ)

এরপর সুরাটির শেষে আল্লাহ তাআলা নবিজীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন-

 فَاصۡبِرۡ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰهِ حَقٌّ وَّ لَا یَسۡتَخِفَّنَّکَ الَّذِیۡنَ لَا یُوۡقِنُوۡنَ

রাজশাহীর সময়/এএইচ