১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০১:২৭:০৭ পূর্বাহ্ন


কোন বয়সে বেশী বৃদ্ধি পায় পর্ণের প্রতি আসক্তি?
ফারহানা জেরিন
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৯-২০২৪
কোন বয়সে বেশী বৃদ্ধি পায় পর্ণের প্রতি আসক্তি? ছবি: সংগৃহীত


সম্প্রতি পাবজি, ফ্রী ফায়ারের মতো পর্ন দুনিয়াতেও রীতিমতো আসক্তি দেখা দিয়েছে যুবসমাজের। যার কারণে একদিকে যেমন তাদের জীবন ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে ঠিক সেইভাবেই দেশ হারিয়ে ফেলছে নতুন প্রজন্মের চিন্তা ধারা। কিন্তু কেন আসক্তি হচ্ছে এই নীল ছবির দিকে যুবসমাজ! উত্তর দিলেন বেশকিছু বিশেষজ্ঞরা -

সবার আগে রোগ নিরাময় করতে গেলে আগের রোগ কি হয়েছে সেটি জানা খুব প্রয়োজন। কোথায় সেই ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি নেশা মুক্ত করতে গেলে আসলে নীল ছবি কি সেই সম্পর্কে অবগত হতে হবে। অধিকাংশ যুবসমাজ তবে শুধুমাত্র ছেলেরা মেয়েরা আজকাল এই নেশার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু কেন সকলের একটাই প্রশ্ন!

উত্তর হচ্ছে সকলের হাতে একটা করে স্মার্টফোন চলে আসায় এবং নেট মাধ্যমে খুব সহজেই ইচ্ছাকৃত জিনিস পেয়ে যাওয়ায় আজকাল বলতে গেলে বাইরে খেলার কথা ভুলে গিয়েছে সিংহভাগ ছেলেমেয়েরা। সুতরাং নিজেদের জীবন মুঠো বন্দী ফোনের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চায় তারা। সেই ক্ষেত্রে ঘরের মধ্যে বসে পাবজি ফ্রী ফায়ার এর মত নেশাযুক্ত খেলার পাশাপাশি নীল ছবির মতন মরণফাঁদে উপাধ্যায় অনেকে। কিন্তু এই পর্ণোগ্রাফি দেখার ফলে যেমন একদিকে মানসিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঠিক সেভাবে শারীরিক দিকেও এর প্রভাব পড়ে। ডায়াগনস্টিক এন্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডার নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক যৌনতাবিষয়ক ভিডিও ছবি দেখার নেশা কেমন রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত না করলেও এর সুদূরপ্রসারী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

নীল লীলাবতী হাসপাতালে মনোবিদ ডক্টর ভারত শাহের দাবি, " ল্যাপটপ ও কম্পিউটার বাদ দিলে এখন ফোরজি, থ্রিজি কানেকশনে দৌড়াতে হাতের মুঠোয় পৌঁছে গিয়েছে পর্ণের পসরা। প্রচলিত বিশ্বাস শুধুমাত্র পুষি এর ভক্ত নন মুম্বাই মিরর পত্রিকা বলছে অন্য গল্প। এই ব্যাপারে মেয়েরাও কোন দিক থেকে পিছিয়ে নেই এর জন্য একমাত্র দায়ী সহজলভ্যতা। পর্ন ওয়েবসাইট পর্নহাব এর এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে পণ্যের প্রতি আসক্ত এক তৃতীয়াংশ নারী। পাশাপাশি তালিকাভুক্ত হওয়া দেশগুলির মধ্যে ভারত তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে।

কোন বয়সে বেশি বৃদ্ধি পায় পর্ণের প্রতি আসক্তি?

গণনা কেন্দ্র বলছে বয়সন্ধিকালে হরমোন ক্ষরণ হোক বা বয়স্কদের কৌতুহল জীবনের কোনো এক সময় অধিকাংশ মানুষই পর্ন দেখেন। বিপদের আশঙ্কা তখনই রয়েছে যখন বিক্ষিপ্ত দর্শন রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়। এই প্রসঙ্গে ডক্টর শাহ বলেছেন যখন দেখবেন চাইলেও পর্ন দেখার অভ্যাস ছাড়া যাচ্ছে না তখনই বুঝতে হবে অতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বিষয়টি ক্ষতিকর জেনেও স্রেফ নেশার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা নেশাতুর ব্যক্তিদের।

কিভাবে বুঝবেন পর নেশায় আসক্তি দেখা দিয়েছে কোন ব্যক্তির। এর ক্ষেত্রেও বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন -

১) সপ্তাহে ১০ ঘণ্টার বেশি পর্ন দেখা।

২) লিঙ্গ উত্থান ও বীর্যপাতের সময় সমস্যা দেখা দেয় অথবা স্বাভাবিক যৌন জীবন ব্যাহত হওয়া।

৩) পর্ন দেখার সময় মেপে সারাদিনের রুটিন তৈরি করা।

৪) বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা অথবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে পর্ন দেখায় বেশি স্বাচ্ছন্দ মনে করা।

৫) ক্লান্তি বিষণ্নতা বা বিরক্তি দূর করতে পর্নকে একমাত্র বিনোদন হিসেবে বেছে নেওয়া।

৬) পর্ন দেখার জন্য ক্রমাগত নিজেকে দোষারোপ করা।

পর্ণ গ্রাফির প্রতি আসক্তি এসে গেলে কি কি ক্ষতি হতে পারে মানব জীবনের ?

l) মানসিক অবসাদ - দীর্ঘদিন ধরে পর্নোগ্রাফি ভিডিও দেখলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষ। পর্নে নেশাগ্রস্তদের প্রায় অতিরিক্ত শারীরিক ক্লান্তি মানসিক অবসাদ অতিরিক্ত মনের উপর চাপের শিকার হতে দেখা যায়। এই বিষয়ে ডঃ পারুল ট্যাঙ্কের ব্যাখ্যা, দীর্ঘ সময় ধরে পর্ন দেখার পরে ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন অফ করার পরেও মনের মধ্যে সেই সমস্ত যৌন উত্তেজক দৃশ্য ঘুরে থাকে। সেই ক্ষেত্রে মানসিক দিক থেকে পরিশ্রম হয় প্রচুর।

ll) লিবিডোর দফারফা - দীর্ঘক্ষন ফোন মে ল্যাপটপ এ নিয়ে ছবি দেখার কারণে যৌনতার প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকে। তাই একসময় যৌন উত্তেজনার ভাঁড়ার নিঃশেষ হয়ে যায়। বাস্তবে যৌনসঙ্গী সহচর্য কাম উত্তেজনা বাড়াতে ব্যর্থ হওয়ায় নষ্ট হয় বহু সম্পর্ক।

lll) ক্ষতিগ্রস্ত কর্মজীবন - যেকোনো নেশার মত পর্ন পেছনে ছোটার খুলে যাবতীয় এনার্জীর প্রায় শেষ হয়ে যায়। শুধুমাত্র পর্ন দেখার তাগিদে অতিরিক্ত ক্লান্তি গান হামেশাই অফিস কামাইয়ের বেশ কিছু দৃষ্টান্ত ইতিমধ্যেই নজরে এসেছে।

পর্নোগ্রাফি থেকে বাস্তব জীবনে ফিরে আসার উপায় !

একদিনে যেমন মানুষের নেশা হয় না সেভাবে একদিন এই নেশা মুক্ত করা অসম্ভব'। তবে কোন ব্যক্তি যদি নিজের মন থেকে সম্পূর্ণ সচ্ছল আগ্রহ তার শহীদ নেশা মুক্ত হতে চায় সেক্ষেত্রে সে ইতিমধ্যে পর্নোগ্রাফি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। যদিও তার জন্য বিশেষ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়মিত পরিলক্ষিত করা একান্ত প্রয়োজন।

l) সচেতন হওয়া আবশ্যক - পর্ণ আসক্তি দূর করার জন্য এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। বলতে গেলে নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রথম পদক্ষেপ এটি। উপলব্ধি করতে হবে পরাশক্তি একটি মনোসামাজিক ব্যাধি। সেই ক্ষেত্রে এর পার্শপ্রতিক্রিয়া শরীর ও মানসিক কুফল ডেকে আনে। স্নায়ুকে ক্রমাগত উত্তেজিত করার মাধ্যমে এটি রক্তচাপ বৃদ্ধি হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত পাশাপাশি হরমোনাল ডিজঅর্ডারের মতো মারাত্মক ঘটনা ঘটায়। সুতরাং এই মারাত্মক ক্ষতিকর জিনিস থেকে দূরে থাকার জন্য প্রথমেই সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।

ll) নির্দ্বিধায় সরিয়ে ফেলতে হবে পর্নোগ্রাফির উপাদান - কোন জিনিস থেকে দূরে সরতে গেলেই একমাত্র সেই জিনিসটিকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। টাইম সেক্সুয়াল যেসব কনটেন্টের হার্ড ড্রাইভ বা ফোনে সংরক্ষিত আছে তা আগে মুছে ফেলতে হবে। পাশাপাশি ইন্টারনেটে সেইসব ওয়েবসাইটের কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য ব্যবহার করতে হবে প্রটেকশনাল সফটওয়্যার। এই ক্ষেত্রে পর্ন সাইট ব্লক করার জন্য কে৯ নামে অসাধারণ একটি ফ্রী সফটওয়্যার রয়েছে যদি ইনস্টল করে খুব সহজেই সাইট ব্লক করা যায়। যে সকল ব্যক্তি সফটওয়্যার বিষয়ে অবগত নন তারা গুগলে গিয়ে হাউ টু ইউস কে৯ ওয়েব প্রটেকশন লিখে সার্চ করলে খুব সহজেই বেশ কিছু টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখতে পারেন।

lll) সুস্থ বিনোদনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে - একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বিষন্ন থাকার কারণে কিংবা একাকীত্ব গ্রাস করার জন্যই এই সকল অসুস্থ বিনোদনের ঝোঁক বেশি পায় নব প্রজন্মের। সেই ক্ষেত্রে অসুস্থ বিনোদন বাতিল করে ভালো গান শোনা মুভি দেখা বই পড়ার মতন ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিহাটা কিংবা জগিং করার মতো এক্সারসাইজ গুলো করলে বাড়তি অনুপ্রেরণা যোগাবে।

lv) ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুসরণ করতে হবে - যে ব্যক্তি যে ধর্ম নিয়ে বড় হয়েছে তারা সেই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে কিংবা মনীষীদের প্রবচন শুনলে মনে আত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটে। এক্ষেত্রে মোহনের পবিত্র হওয়ার ফলে পাপা শক্তি থেকে প্রত্যাবর্তন করে নির্মল জীবন শুরু করা খুব সহজলভ্য হয়।

v) মানসিক চিকিৎসার নেওয়া যেতে পারে - কোন ব্যক্তি পরাশক্তি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের থেকে সকল জিনিস ব্যবহার করার পরেও যদি সে অশোভন হয় তাহলে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনোবল বৃদ্ধির একাধিক পরামর্শ দেন। সে ক্ষেত্রে একাধিক কাউন্সিলিং করাতে হয় এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ মাফিক জীবন পরিচালনা করতে হয়। ভালো অভ্যাস গুলো প্রতিনিয়ত চর্চা করলে কু অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়।

vi) নতুন শখ পুষতে হবে - যদি কোন মানুষ কোন শক্তি থেকে সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে আসতে দেয় তাহলে তাকে প্রথমে ঘর থেকে বেরোতে হবে। ঘরে বসে থাকলেই হয় ল্যাপটপ কম্পিউটার টিভির মধ্যে মুখ গোজা ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। সেই ক্ষেত্রে বাইরের দুনিয়ায় এসে নতুন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় হলে পর্ন দেখার কথা আর মাথায় আসবে না। প্রাথমিকে বিষয়টি কঠিন লাগলেও পরে সহজলভ্য হয়ে যাবে। পাশাপাশি বিভিন্ন ভালো নেশা যেমন বডি বিল্ডিং এর জন্য জিম জয়েন করা, গিটার বাজানো, গান শেখা, কবিতা আবৃত্তি করা, সাঁতার কাটা ,ছবি আঁকার মত বহু ধরনের কাজ আছে যা একজন মানুষকে ব্যস্ত রাখার পক্ষে যথেষ্ট।

vii) ব্রাউজিংয়ের অভ্যাস করা যেতে পারে - এই ক্ষেত্রে উইকিপিডিয়ার মধ্যে পর্নোগ্রাফি দৌড়নো সৃষ্টির উদ্যোগ যৌন সংক্রান্ত বিষয় বস্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কন বা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। অর্থাৎ বিগত কয়েক দশকে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন তথা ভোগ্যপণ্য হিসেবে ভোটকে কেন্দ্র করে একটি বিরাট শিল্প গড়ে উঠেছে বর্তমানে জেটি ইন্টারনেটের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত। তাই ইন্টারনেটে বসে সময় কাটানো কমিয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় নেট মাধ্যমে কাজ দ্রুত শেষ করে সামাজিক মেলামেশা ও কর্মে তৎপর হয়ে উঠতে হবে। মানে ভার্চুয়াল জগতে সময় অপচয় না করে সামাজিক জগতে ফিরে আসতে হবে।

viii) পারিবারিক সম্পর্ক মজবুত করতে হবে - পরিবারকে অধিক সময় দিতে হবে। নির্জনতা ও একাকীত্ব থেকে বেরিয়ে এসে পিসি বা ল্যাপটপ রুমের এক এমন একটা পজিশনে রেখে ব্যবহার করতে হবে যেন সেটা রুমে ঢুকলে সবার দৃষ্টি গোচর হয় অর্থাৎ বাবা-মা বা সন্তান-সন্ততিদের সামনে ল্যাপটপ কিংবা ফোনে অপ্রীতিকর জিনিস দেখা কারোর পক্ষে সম্ভব না। কাজের দিনগুলোর ফাঁকে সুন্দর উদ্যোগগুলো আমাদের পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করার পাশাপাশি এনার্জি পেতে সাহায্য করে।

ix) দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বদল আনতে হবে - পর্ন বলতে যে প্রচন্ড আকর্ষণীয় রগরগে যৌনতা প্রদর্শনী চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটি সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য এক বিশাল হুমকি। সেই ক্ষেত্রে নারী সত্যাগ্রহ অবমাননা করা হয় তার বিরুদ্ধে চিন্তা চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে এবং মহিলাদের উপর পাশবিক অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। বিষয়টিকে সমাজ পরিবার ও স্বাভাবিক যৌন জীবনের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে সেই অনুপাতে নিজের ভেতরের লড়াকু মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।

সর্বশেষ কথায় বলতে গেলে বলা যায় পর্নোগ্রাফি বা যে কোন নেশা থেকে একদিনে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ নিজের পক্ষ থেকে চেষ্টা করার পরেও ব্যর্থ হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাউন্সিলিং নিতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ মতো জীবন যাপন করলে অবশ্যই একদিন সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ফল আপনি নিজেই দেখতে পাবেন।