ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি ছড়ানো, ধর্ম অবমাননা, এমনকি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জুয়া খেলার অভিযোগেও অল্প বয়সীদের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে। ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কমপক্ষে ২০ শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে ১২ জেলায় ১৮টি মামলার কথা জানা গেছে।
দেশের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ হিসাব দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দৃক। এসব মামলার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। মামলাগুলো করেছেন সরকারদলীয় লোকজন, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যক্তিরা। এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে এই শিশু–কিশোরদের পাঁচ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ লাখ থেকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা কয়েকটি মামলা হাইকোর্টে পরিচালনা করছেন আইনজীবী ইমাম হোসেন তারেক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ বছরের নিচে কেউ নথিপত্রে সই করতে পারে না, ভোট দিতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাঁর মতে, শিশুদের এ আইনে গ্রেপ্তার করার একটাই উদ্দেশ্য থাকতে পারে, ভয় দেখানো।
এ আইনে মামলা করার আগে ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি নেওয়ার নির্দেশনা আছে বলে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে তা অনুসরণের সুযোগ হয় না। কখনো কখনো পরিস্থিতির অবনতি এড়াতে পুলিশ বাদী হয় বলে জানান তিনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কার্যকর হয়েছে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর। এর পরের তিন বছরে এ আইনে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৬৫৭টি। তবে সারা দেশে মোট কত শিশুর বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে, সে তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, তারা আসামির বয়সভিত্তিক মামলার হিসাব রাখে না।
কটূক্তির অভিযোগে মামলা
ফেসবুকে ‘কটূক্তি করা পোস্ট’ শেয়ার করায় জামালপুর, ময়মনসিংহ, রংপুরের পীরগঞ্জ ও পীরগাছা এবং নারায়ণগঞ্জে ছয় শিশু–কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজনের অভিভাবকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলছেন, শিশুরা না বুঝে পোস্ট শেয়ার করে। ভুল বুঝতে পেরে পোস্ট প্রত্যাহার করে ক্ষমাও চায়।
একটি শিশুর বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। গত বছরের অক্টোবরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার চাচা বলেন, অনলাইন ক্লাসের জন্য তাঁর ভাইপো স্মার্টফোন ব্যবহার করছিল। হঠাৎ একদিন বাসায় পুলিশ এসে তার খোঁজ করে। পুলিশ জানায়, সে মুঠোফোনে বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করেছে। পুলিশকে দেখে ছেলেটি ভয়ে কাঁদতে শুরু করে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৭ দিন পর জামিনে মুক্তি পেলেও এখনো আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মামলার বাদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।
১৮ বছরের নিচে কেউ নথিপত্রে সই করতে পারে না, ভোট দিতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ইমাম হোসেন তারেক, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক মামলায় ময়মনসিংহের এক স্কুলছাত্রকে আসামি করা হয়। সে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে একটি পোস্ট দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর ক্ষমা চেয়ে সেটি সরিয়েও ফেলে। তার স্বজনেরা জানান, ঘটনার দিন বিকেলে সে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে ক্ষমা চায়। এরই মধ্যে পুলিশ আসে বাড়িতে। তার মুঠোফোন দিতে বলে। রাতে ওই কিশোরকে থানায় দিয়ে আসেন স্বজনেরা। ১৫ দিন পর জামিনে মুক্তি পায়। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে সে। ভয়ে সে লেখাপড়া করতে পারছে না বলে জানান স্বজনেরা।
নবম শ্রেণির এক ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা হয় জামালপুরে। বাবা ছেলেকে বাঁচাতে বলেন, গৃহশিক্ষক ছেলের আইডি থেকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। ওই গৃহশিক্ষক জানান, ছাত্রের সঙ্গে তাঁকেও কারাগারে যেতে হয়। ওই ছাত্রের পক্ষে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে এসেছিল আরেক ছাত্র। সে–ও গ্রেপ্তার হয়। তিনজন আড়াই মাস জেলে ছিলেন।
নারায়ণগঞ্জের এক মামলায় আসামি করা হয় চুয়াডাঙ্গার এক কিশোরকে (১৫)। হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর এক ব্যক্তির দেওয়া পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার করেছিল সে। কটূক্তির অভিযোগে কিশোরটিসহ তিনজনের নামে মামলা হয়।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মামলা
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দুই কিশোরীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে সাতটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ছয়জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই শিশু–কিশোরেরা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছে, পরিবারও একঘরে হয়ে আছে। ক্ষমা চেয়েও আইনি ঝামেলা এড়াতে পারেনি পরিবার।
গ্রেপ্তার দুই কিশোরীর বাড়ি বগুড়ার শেরপুর ও দিনাজপুরে। তাদের একজন মাদ্রাসাছাত্রী। সে ২০২০ সালের নভেম্বরে ফেসবুকে একটি ভিডিও আপলোড করেছিল। পুলিশ জানায়, মেয়েটি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চলে গিয়েছিল। স্থানীয় লোকজন তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। রাতেই কালিয়াকৈর থেকে তাকে ধরে আনা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে মামলা হয়। শেরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তন্ময় কুমার বর্মণ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে, মামলার বিচারকাজ চলছে।
দিনাজপুরের কিশোরী দেড় বছর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ছিল। সম্প্রতি জামিন পেয়েছে। আদালতে দোষ স্বীকার করে অনুতপ্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে সে। তার বাবা রাজশাহীর সময় কে জানান, মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। মেয়ে সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছে, খুব একটা কথাবার্তা বলছে না। গত বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, দিতে পারেনি। লোকজন কী চোখে দেখবে, লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে কি না, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে পরিবার।
কী বলছেন বাদীরা
এক হাজার টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর মাস্ক পরা একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেটি শেয়ার করে গ্রেপ্তার হয় রংপুরের পীরগঞ্জের এক কিশোর। তার বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী থানার এসআই মুবিনুর রহমান বাংলার বিবেক কে বলেন, স্থানীয় লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। তখন কোন পরিস্থিতিতে মামলা করতে হয়েছিল, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন।
ময়মনসিংহে কটূক্তির অভিযোগে শিশুর বিরুদ্ধে মামলা করেন ভালুকার হবিরবাড়ী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ মোহাম্মদ। তিনি বাংলার বিবেক বলেন, ‘ফেসবুকে দেখে বয়স বোঝা যায়নি। আমার দল যদি মনে করে বিষয়টা মানবিকভাবে দেখা যায়, সে তো ছোট।’
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় এক শিশুর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন স্থানীয় একটি পত্রিকার সাংবাদিক আরিফুজ্জামান চাকলাদার। তাঁর দাবি, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পরিস্থিতি শান্ত করতে তিনি মামলা করেন।
তবে বগুড়ার মাদ্রাসাছাত্রীর বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী জুয়েল রানা বলেন, এলাকার লোকজনের মতো তিনিও ক্ষুব্ধ হন। তাই তিনি মামলা করেন।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে একদল কিশোর-তরুণ টিকটকের ভিডিও বানাতে গিয়ে মামলায় জড়িয়েছে। ২০২০ সালের আগস্টে ওই দলের একজনের (১৩) গলায় দা ধরে ভিডিও করা হয়। এ ব্যাপারে স্থানীয় এক ব্যক্তি ফেসবুকে পোস্ট দিলে আটজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
যার গলায় দা ধরে ভিডিও করা হয়েছিল, তার বড় ভাই মামলা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইও ওই দলের সদস্য। তারা টিকটক ভিডিও বানায়। অন্যের পরামর্শে মামলা করেন তিনি।
বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যায়
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) ফোন করে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে রাজধানীর বনানী থানায় একটি মামলা হয়। এ মামলায় নাটোর ও কুষ্টিয়ার দুই শিশুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নাটোরের শিশুটির বয়স ১৩।
ফোনে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হলো কেন, এ প্রশ্নের জবাবে নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন দাস প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটি একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ফোন করেছিল। তবে কঠোর ধারা দেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিশুটির বিরুদ্ধে ২৩(৩) ধারায় মামলা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে ১০ বছর কারাদণ্ড বা সাত লাখ টাকা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
২০২০ সালে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে এসএসসি পরীক্ষার হল থেকে মুঠোফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে বাইরে পাঠানোর অভিযোগে দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে মামলা হয়। এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা করা হয়।
আইনজীবী ইমাম হাসান তারেক বলেন, বিকল্প থাকলেও অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে আগ্রহী হচ্ছেন। কারণ, আইনটির কিছু ধারা জামিন অযোগ্য। যাঁরা মামলা করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য আসামিরা যেন সহজে জামিন না পান, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বিবেচনা করছেন না তাঁরা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদ বাংলার বিবেক কে বলেন, এসব শিশু–কিশোর সাময়িকভাবে বিষণ্নতা এবং আঘাত–পরবর্তী মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। লঘু পাপে গুরু দণ্ডের কারণে পরে কেউ কেউ গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে পড়তে পারে।
রাজশাহীর সময়/এজেড