তাঁরা হয়তো রাজপ্রাসাদে থাকেন। চোখ ঠিকরানো গয়না পরেন। বৈভব-বাহুল্য উপচে পড়ে তাঁদের ঘরে। কিন্তু তাঁদের দেশের বিখ্যাত এক রাজা বলেছেন যে, আমিও পাঁউরুটি খাই। আমিও নিশ্বাস নিই। আমারও সাহচর্যের প্রয়োজন আছে। সত্যি, কী রকম রাজা!
এই রাজপরিবারের মধ্যে এক সপ্তাহে পর পর দু’টি সুনামি। ধরা পড়ল রাজার ক্যানসার হয়েছে। এবং আরও আশ্চর্য, সেটা তাঁরা প্রকাশ্যেই স্বীকার করলেন। রাজা চার্লসের বয়স ৭৫। যুবরানিকে নিয়ে নাটক আরও বেশি। তাঁর বয়স ৪২। তিনি হঠাৎ হাসপাতালে ভর্তি হলেন। বলা হল পেটে অস্ত্রোপচার হয়েছে। হতেই পারে অ্যাপেন্ডিক্স কিংবা অন্য কিছু। কিন্তু ও মা! দিনের পর দিন কেটে গেল, হাসপাতাল থেকে বেরোনোর কোনও লক্ষণ নেই। আমাদের দেশে হলে বলা যেত যে, ইডি-র হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাসপাতালের কবচ ব্যবহার করছেন। জেলের থেকে হাসপাতাল ভাল। যুবরানির তো জেল নয়। প্রাসাদ ছেড়ে হাসপাতালে আছেন। কী হতে পারে?
এমনিতে বিলেতের সংবাদপত্র খুব মুখরা। কিন্তু রাজপরিবার বলে কথা। ভারতবর্ষের সংবাদমাধ্যম যেমন মোদী বা দিদির ভক্ত, ওখানকার সংবাদমাধ্যম তেমন রাজভক্ত। এত দিনে পৃথিবীতে ইন্টারনেটও এসে গিয়েছে। ফলে নানা রকম অবিশ্বাস্য কল্পনা ছড়াতে লাগল। যেমন কেউ বললেন, যুবরানি আসলে মারাই গিয়েছেন। তাই তাঁকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এই সব জল্পনার মধ্যে জানানো হল যে, যুবরানি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন। এবং ছাড়া পাওয়ার পর তিন সন্তানের সঙ্গে একটি ছবিও প্রকাশ করা হল। ছবিটি তুলেছিলেন তাঁর স্বামী যুবরাজ। কিন্তু বিলেতের সংবাদমাধ্যমের যেমন ভক্তি আছে, আমেরিকার সংবাদপত্র বড়-ছোট কাউকেই ততটা খাতির করে না। আমেরিকার প্রধান সংবাদ সংস্থা এপি (এখানকার পিটিআই-এর মতো) দুম করে একটা বোমা ফাটিয়ে দিল। বলে বসল, যে ছবি রাজপরিবার থেকে পাঠানো হয়েছিল, তার প্রকাশ তারা প্রত্যাহার করছে। তার পর তার প্রধান সম্পাদক প্রত্যেক গ্রাহকের কাছে একটি চিঠি লিখলেন। তাতে স্পষ্ট বললেন, এই ছবিটিতে কারসাজি আছে। ডিজিটালে তা সহজেই করা যায়। ফলে ছবি আসল নয়। বানানো। এই চিঠি পড়ার পর বিলেতের রয়টার্সও ছবিটি প্রত্যাহার করল। একই কারণ দেখাল। এর পর সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গও একই কাণ্ড করল। বারুদে আগুন লাগল।
যে যুবরাজ আর যুবরানি সিংহাসনে বসার অপেক্ষায় প্রায় গোটা ব্রিটেন, তাঁদের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। এখন ডিজিটাল মাধ্যমের যুগ। জাল ছবি ছাপার অনেক বেশি খেসারত দিতে হয়। তাই যে যুবরাজ-যুবরানি সিংহাসনে বসার অপেক্ষায় রয়েছে আপামর ব্রিটেন, সেই ভক্তির সঙ্গে খানিক আপস করতে হল সে দেশের সংবাদ সংস্থাদের। ‘ফেক’ বা জাল ছবি ছাপার মতো অনৈতিক কাজ করার সাহস দেখানো কঠিন। তিন সন্তান, ১০ বছরের রাজপুত্র জর্জ, ৮ বছরের রাজকন্যা শার্লট এবং সবে ৫-এ পা দেওয়া রাজপুত্র লুইসের সঙ্গে তাদের মায়ের সেই মনোরম ছবি প্রকাশ করার আবেগ সামলাতে হয় তাদের অনেককেই।
ছবিতে কারসাজি আছে শুনে ভেঙে পড়েন অনেকে। কেউ বলেন মন্দ কথা বলা হচ্ছে তাদের প্রিয় ডায়ানার পুত্র উইলিয়ামের পরিবারকে নিয়ে। কেউ আবার মনে মনে বলেন, শেষে ডায়ানার ছেলে এমন হলেন! সাহেবদের এই ভক্তি নিয়ে হিমশিম খাওয়ার পর্ব সমাজমাধ্যমে বড় আকার নেয়। দেশ-বিদেশের সব সংবাদপত্র তা নিয়ে লিখতে থাকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সব শুনে বলেছিলেন, ‘‘তুচ্ছ ঘটনা।’’ কিন্তু ব্রিটেনের কাছে এ সব তুচ্ছ নয়। রাজা-রানিদের নিয়েই বাঁচেন তাঁরা। রাজপরিবার নিয়ে যে একটি মোহাচ্ছন্ন ভাব থাকে ব্রিটেনে, তা যেন কিছুটা ক্ষুণ্ণ হতে শুরু করে এ ক্ষেত্রে। বিষয়টা বেড়ে যাচ্ছে দেখে রাজপরিবার সেই ঝঞ্ঝাটের দায় নেয়। যাঁকে নিয়ে এত হুলস্থূল, সেই কেট নিজেই সমাজমাধ্যমে লিখে দেন, ছবির কারসাজি তাঁর হাতেই হয়েছে। যে ছবি উইলিয়াম তুলেছেন বলে শোনা গিয়েছিল, তা আবার কেট কেন এডিট করতে গেলেন?
কেটের ছবি-কেলেঙ্কারি বড় আকার নেয়। যতই সরল বধূ নিজেদের ছবি নিয়ে খেলাচ্ছলে এডিট করেছেন, এমন ভঙ্গিতে কেট সমাজমাধ্যমে ক্ষমা চান সকলের কাছে, বিষয়টি তাতে ধামাচাপা পড়েনি। আমেরিকার ‘পিপ্ল’ পত্রিকা বিষয়টিকে জনসংযোগে একটি বড়সড় ত্রুটি বলে মন্তব্য করে বসে। তাতে গলা মেলান আরও কেউ কেউ। এবং ১০ মার্চ সে ছবি প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে অন্তত ১০-১২ দিন তা নিয়ে নানা ভাবে চর্চা চলে। যখন কেটের জা মেগান রাজবাড়ি ছাড়লেন, সে সময়ে লোকে বলেছিল, এ হল বড় ঘরের ছোট কথা। আর কেট-কাণ্ড শুনে তাঁকে বলছে, ‘‘এ বার শুরু হয়েছে বড় ঘরের বড় কথা’’।
কেটের ছবি-কেলেঙ্কারি নিয়ে চর্চা চলার ১২তম দিনের মাথায় ঘটল নতুন বিস্ফোরণ। এ বার এল ভিডিয়ো। যুবরানি নিজে মুখে বলে বসলেন, তাঁর ক্যানসার হয়েছে। কোথায় ক্যানসার, কত দিন লাগবে চিকিৎসা করতে, এখন কোন স্তরে রয়েছে, সে সব কিছুই আলোচ্য নয়। এমনকি, জানুয়ারি মাসে অস্ত্রোপচারের আগে রাজবাড়ি থেকে যেচে যে জানানো হয়েছিল, যুবরানির ক্যানসার হয়নি, সে কথাও উঠল না।
সাধারণত কেউ অসুস্থতার কথা বললে তার মধ্যে গুজব খোঁজা হয় না। নিন্দামন্দও থেমে যায়। তার পরে স্বয়ং যুবরানি ভিডিয়োতে মুখ দেখিয়ে জানাচ্ছেন, তিনি অসুস্থ। ক্যানসারে আক্রান্ত। চিকিৎসা চলছে। তখন আর জনতাকে পায় কে! যে যুবরানি বিয়ের ১৩ বছরের মধ্যে এক বারও মনে রাখার মতো কোনও বক্তব্য রাখেননি, যাঁকে জনসমক্ষে সাধারণ কৌতূহল প্রকাশ করতেও দেখা যায় না, তিনি কেন হঠাৎ নিজের অসুস্থতার কথা সকলের সামনে এসে বললেন, যে সময়ে তাঁর স্বামী তাঁরই বন্ধুর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়েছেন বলে চর্চা চলছে চারদিকে? সে কৌতূহল কি হল কারও? ২ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের সেই কোমল ভিডিয়োই এখন খালি ঘুরপাক খাচ্ছে এক জনের সমাজমাধ্যমের পাতা থেকে আর এক জনের সমাজমাধ্যমের পাতায়। যে রাজপরিবার নিজেদের ব্যক্তিগত শোক-দুঃখ প্রকাশ করায় বিশ্বাসী নয়, এমনকি রানি এলিজাবেথ যে মৃত্যুশয্যায়, সে কথাও যারা প্রকাশ করেনি, তারা হঠাৎ ৪২ বছর বয়সি যুবরানির অসুস্থ হওয়ার খবর তাঁরই মুখ দিয়ে বলার অনুমতি দিল কেন?
যুবরানির সেই ভিডিয়ো প্রকাশের পর দিন দুয়েকের মাথায় চর্চার মোড় ঘুরে গেল। ব্রিটেনের একাধিক সংবাদপত্র তাঁর স্বাস্থ্যের হাল নিয়ে খবর করল। কেউ কেউ সে সবে না গিয়ে যুবরানি কত জনদরদি, তা নিয়ে মগ্ন হল। কবে নাম না জানিয়ে ক্যানসার রোগীদের জন্য চুল দান করেছেন কেট, সে সব লিখতে ব্যস্ত হল বিভিন্ন সংবাদপত্রও।