শিক্ষা শান্তি আর সৌন্দর্যের নগরী হিসেবে পরিচিত রাজশাহী বিগত ২০২৩ সালে হাসি কান্না আর নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে চলে গেল। নগরীর দৃষ্টিনন্দন উন্নয়নের পাশপাশি বেমানান ছিল হত্যা খুন জখমের ঘটনা। বিশেষ করে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ংকরভাবে বেড়ে ওঠা। তারা পোশাক, মোবাইল আর মাদকের টাকা যোগাড়ে নেমে পড়ে অপকর্মে।
জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীতে জনসভা করতে এসে বেশকিছু উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও ফলক উন্মোচন করেন। কেন্দ্রীয় উদ্যান সংলগ্ন জমিতে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার আলোর মুখ দেখেছে।
রাজশাহী সিটি নির্বাচনে মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন তৃতীয়বারের মত নির্বাচিত হয়েছেন। নগরীকে আরো আলোকজ্জ্বল ও ফুলেল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি রয়েছে এখানকার মূল সমস্যা কর্মসংস্থানের। তেমন কোনো শিল্প করখানা না থাকায় বেকারত্ব বেড়েছে। আর বেকারত্বের কারণে যুব-কিশোররা হতাশায় ভুগে ভুলপথে পা বাড়াচ্ছে। বিভিন্ন কারণে আটক ২৩ শিশু-কিশোরকে ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা হিসেবে মুক্তি দিয়েছে নারী ও শিশু আদালত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খনি ও ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তাহেরকে হত্যার দায়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ও এলাকার অন্য একজনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। রাজশাহীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. কাজেম আলীকে রহস্যজনকভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এমনি হত্যাকা-ের শিকার হন গ্রাম্য চিকিৎসক এরশাদ আলী দুলাল। ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে অনেক মানুষ আহত হয়েছে।
রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে হাসপাতালে মারা যান। রাজশাহী কোর্ট হাজতে রহস্যজনকভাবে এক যুবকের মৃত্যু হয়। সুজন (৩৮) নামে এক ব্যক্তিকে নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় অপহরণ করে কোটি টাকা পণ হিসেবে না পেয়ে তাকে হত্যা করা হয়। রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় খুন-খারাবীর ঘটনা ছিল বেশ উদ্বেগজনক। জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে তিনজন খুন হয়। বাঘায় ছেলের হাতে পিতা আজিজুল খুন হন। জেল থেকে বের হয়ে স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে খুন করে স্বামী মুরাদ হোসেন। তানোরে স্বামী খুন করেছে স্ত্রী নিপা খাতুন ও শিশু নুরনবীকে। এমনি অসংখ্য খুনো খুনি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
কর অফিসের বড় কর্তা রাজশাহীর বিশিষ্ট চিৎিসক ডা. ফাতেমা সিদ্দিকার আয়কর ফাইল আটকিয়ে দশ লাখ টাকা ঘুষ নেবার সময় দুদকের হাতে আটক হয়ে কারাগারে যায়। অন্যদিকে সেই চিকিৎসককে পরবর্তীতে জামায়াতের অর্থদাতা হিসাবে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। বছরজুড়েই রাজশাহী সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী বিএসএফ ছিল মারমুখী। এবছর তাদের গুলিতে নিহত হয়েছে গোদাগাড়ীর চারজনসহ আহত হয়েছে বেশকজন সীমান্তবাসী মানুষ। মে মাসে সীমান্ত এলাকায় ঘাস কাটতে গিয়ে দুই কিশোর বিএসএফ-এর গুলিতে আহত হয়। অক্টোবরে মিঠুন আলী নামে যুবক নিহত হয়। নভেম্বরে সামিরুল নামে এক কিশোর নিহত হয়। গত ২০ ডিসেম্বর বিএসএফ এর তাড়া খেয়ে নদীতে ডুবে দুজন মারা যায়।
কৃষি নির্ভর রাজশাহীতে আমের ভাল ফলন হওয়ায় আম চাষীরা লাভের মুখ দেখেছে। যদিও আবহাওয়ার বৈরী আচরণে মানুষ পশুপাখি কৃষি সর্বত্র ছিল বিরূপ প্রভাব। খরা মওসুম যেমন তাপমাত্রা ছিল চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তেমনি শীত মওসুমে প্রায় চার ডিগ্রী সেলসিয়াস। ফলে খরার পুড়েছে মানুষ প্রকৃতি। অন্যদিকে প্রচ- শীতে কাবু ছিল। প্রলম্বিত খরা ভুগিয়েছে কৃষিতে। অনাবৃষ্টির কারণে পাতালের পানি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে হয়েছে। মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণও অর্ধেকে নেমে আসে ২৫০০ মিলি থেকে ১২০০ মিলিমিটারে। ফারাক্কার গেট না খোলায় এবার মরা পদ্মায় বান ডাকেনি। অক্টোবরের শেষ দিকে দুদিনের প্রবল বর্ষণে খাল-বিল-পুকুর-ডোবা, এমনকি রাজপথে পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে খানিকটা রিচার্জ হয়েছে। আবার নিম্নচাপের কারণে অগ্রহায়নের বৃষ্টিতে কৃষকের কপালে ভাঁজ ফেলেছিল।
নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিষের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় রাজশাহীর মানুষকে তার আঁচ অনুভব করতে হয়েছে। সব শ্রেণীর মানুষ দারুণ কষ্টে রয়েছে। বছরজুড়ে রাজশাহীর রাজনীতিতে ছিল নরম গরম খেলা। দীর্ঘ পনের বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা ছিল এক সময়ের বিএনপির দূর্গ বলে খ্যাত রাজশাহীর রাজনীতি। তাদের ঘরের মধ্যে আটকে ছিল সবকিছু। নির্বাচনের বছরের কারণে বছরের শুরু থেকে বিভাগীয় সমাবেশের মধ্যদিয়ে রাজপথে সোচ্চার হয় বিএনপি। পদে পদে বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বিভাগীয় সমাবেশ রোর্ডমার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচি শুরু করে। নেতাকর্মীরা সোচ্চার হয়। এ যেন খাঁচা থেকে মুক্ত বন্দি পাখি। কিন্তু সে সুখ বেশিদিন টেকেনি। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে কারা ও ঘরবন্দি। রাজশাহী কারাগার বন্দিতে ঠাঁসা। রাজপথেও নামতেও মানা। আবার সেই প্রতিকুল অবস্থা। ক্ষমতাসীন দলের সবাই খুব সুখে নেই। দলের কোন্দল তীব্র। এদিকে নারী ঘটিত বিষয়ে অডিও ভিডিও কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়েন দু’জন এমপি একজন বড় পদের নেতা ও ছাত্রলীগের নেতা। একজন এমপি শিক্ষক পিটিয়ে সংবাদের শিরোনাম হন। একেবারে শূন্য থেকে অর্থবিত্তে ক্ষমতায় হিরো বনে যাওয়ার সংখ্যাও কম নয়।