এক সময় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করলেও এখন নীরব বিদেশী কূটনীতিকরা। তারা চায় সুষ্ঠু নির্বাচন। তাই নিবিড়ভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। এদিকে বিদেশীদের তৎপরতায় উৎসাহিত হয়ে লাগাতার আন্দোলন করলেও তা সফল না হওয়ায় বিএনপি হতাশ হয়ে পড়েছে ।
সূত্র মতে, এক সময় বিদেশী কূটনীতিকদের অধিকতর তৎপরতায় ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী হয়ে বর্তমান সরকারের পতনের হুমকিসহ বিভিন্নভাবে হাঁকডাক দিলেও আন্দোলন সফল না হওয়ায় রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি এখন চরম বেকায়দায়। না পারছে আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে দিতে, না পারছে নির্বাচনের পথে ফিরে আসতে। তবে নির্বাচন বর্জন করলেও নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। কিন্তু এ আন্দোলনে নেতাকর্মীদের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে কোথাও কোথাও স্বল্পসংখ্যক নেতাকর্মী ঝটিকা মিছিল করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সটকে পড়ছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিছিলের ছবি আপলোড করে আন্দোলনে সক্রিয় থাকার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে দলটির নেতাকর্মীরা।
এক সময় ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফরে এসে ঘন ঘন বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করলেও এখন তাদের আনাগোনা প্রায় থেমে গেছে। এ ছাড়া আন্দোলনরত বিএনপির দাবির প্রতি কোনো দেশেরই সায় নেই। তবে ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের পাশাপাশি বিশ্বের সকল দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাই চায় সুষ্ঠু নির্বাচন। এ জন্য তারা নিবিড়ভাবে নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
উল্লেখ্য, এক সময় সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চাপে রেখে সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে সোচ্চার হয় বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। একপর্যায়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সংবিধান অনুসারে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়া হয়। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ চালান ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনৈতিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধি দল। তারা দফায় দফায় বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সরকারের মন্ত্রী ও আমলা এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে তা জানতে চান। এ সময় বিএনপি ছাড়া সবাই বলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা সহযোগিতা প্রয়োজন দেওয়া হবে। তবে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন দলটির নেতারা।
ইসির তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের যাবতীয় প্রক্রিয়া যথা নিয়মে চলতে থাকা এবং নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অধিকাংশ দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিদেশীদের ধারণা পাল্টে যায়। আর বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ধারাবাহিক হরতাল-অবরোধের মতো নেতিবাচক আন্দোলন করতে থাকায় বিদেশীরা বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবে কোনোভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বিঘিœত হয় কি না সেদিকে গভীর দৃষ্টি রাখে তারা।
এদিকে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে দেশি-বিদেশী চাপকে আমলে নিয়ে নির্বাচন কমিশন কঠোর অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের মিত্ররাও সংবিধান অনুসারে দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর তা করার জন্য সতর্ক অবস্থানে থেকে নিজ নিজ দলের পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম এগিয়ে নিতে থাকেন। যে কারণে এখনো কোনো দেশ থেকে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। বরং কোনো কোনো দেশ থেকে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করা হয়। ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখা গেলে কোনো দেশই এ নিয়ে আর কথা বলার সুযোগ পাবে না। তাই নির্বাচন কমিশন ও সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এক বছর আগে থেকে বিএনপি দেশ-বিদেশে দৌড়ঝাঁপ করে আগে কিছু দেশের সহানুভূতি পেলেও এক পর্যায়ে তাদের ধারণা পাল্টে যায়। তাই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করলেও তাদের দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া যায়নি। কোনো একটি দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বলেনি। তবে তারা সবাই সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছে। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে শর্তহীন সংলাপ করতে বলেছে। নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নিতেও কোনো কোনো দেশ বিএনপির প্রতি তাগিদ দেয়। কিন্তু বিএনপি সংলাপের আগে আওয়ামী লীগকে শর্ত দেওয়া এবং ইসির সংলাপ বর্জন করায় বিদেশীরা কিছুটা নাখোশ হয়। তাই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা কার্যত : নীরব হয়ে যান। এখন আর বিএনপির সঙ্গে তাদের মিটিং-সিটিংও হয় না।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এক বছরেরও বেশি ধরে রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। সেই সঙ্গে এই দাবির পক্ষে সমর্থন আদায় করতে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের পাশাপাশি প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে চিঠি চালাচালি করেন দলের সিনিয়র নেতারা। কিন্তু কোনোভাবেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করতে পারেনি বিএনপি। যে কারণে বিএনপি ছাড়াই দেশে নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে দেখে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে বলে সূত্র জানায়।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্য একটি দেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো পরামর্শ বা প্রস্তাব দিতে পারে না। তাই বিএনপি ত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমর্থন পেতে অনেক দৌড়ঝাঁপ করলেও সে দাবির পক্ষে বিদেশীদের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিএনপিকে বিকল্প ভাবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সরকার ও ইসিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বারবার বলা হয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ইতোমধ্যেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।
সূত্র মতে, বিএনপি মনে করছে দলের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে গেলে ফল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অধিকাংশ দল ভোটের প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও বিএনপি তা বর্জন করে সমমনা কিছু ছোট দলকে নিয়ে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল, জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনের মাঠে অধিকতর সক্রিয় হয়েছে।
বিএনপি হাইকমান্ড প্রত্যাশা করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন জানাবে। কিন্তু বহু দেন-দরবার ও চেষ্টা তদ্বির করেও বিএনপি তাদের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ, সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করার কথা বিদেশীরা বলতে পারেন না।
এদিকে এক সময় বিদেশীরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসবে না বলে জানালেও এখন অনেক দেশ থেকেই নির্বাচন পর্যবেক্ষক আসছে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশের দুই শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এদিকে বর্তমান সরকার দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করার পাশাপাশি দেশকে বিশ্ব দরবারে উচ্চ স্থানে নেয়ার চেষ্টা করছে তা অধিকাংশ প্রভাবশালী দেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। আর বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভাল কিছু করতে পারবে না এমনটি ভেবেই তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না বহির্বিশ্ব। বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমর্থন লাভ করতে না পারা এটিই প্রধান কারণ বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। তাই বিদেশিরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখন আর তেমন কথা বলছে না।