২৫ নভেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১২:৪২:৪৭ অপরাহ্ন


ঢাকাবাসীর চলাচলে অনন্য টেকসই মাধ্যম মেট্রোরেল
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-১২-২০২৩
ঢাকাবাসীর চলাচলে অনন্য টেকসই মাধ্যম মেট্রোরেল


শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসাবে সারাবিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহন ও বাস্তবায়নে অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, যোগাযোগ, ব্যবসাবাণিজ্য ও নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সরকারের ১০টি বৃহৎ প্রকল্পের সুফল নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদন-

দেব দুলাল মিত্র : ভয়াবহ যানজটে ঢাকাবাসীর স্বাভাবিক চলাচল যখন এক রকম স্তব্ধ হওয়ার উপক্রম; তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের মাধ্যমে তিনি দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে আরো একটি মাইলফলক স্থাপন করেন। টেকসই উন্নয়নের লক্ষে জাপানের সহযোগিতায় এই মেগা প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। গঠন করা হয় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এটি সরকারের একটি অগ্রাধিকারভিত্তিক মেগা প্রকল্প। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধন করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করে।
যানজটের ভোগান্তি দূর করা ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘিরে মেট্রোরেলের এক মেগাপ্রকল্প হাতে নেয়। সরকার মোট ৬টি মেট্রেরেল প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পটি অন্যতম। ইতোমধ্যেই উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচলের সুফল দেশের মানুষ ভোগ করছে। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য কমলাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এরপর ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা-আশুলিয়া, ঢাকা-গাজীপুর, ঢাকা-নারায়নগঞ্জ এবং ঢাকা-পূর্বাচল সিটির সঙ্গে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু

হবে। মেট্রোরেলের পাশাপাশি উড়াল সড়ক ও পাতাল রেল নির্মাণ করা হবে। সব মিলিয়ে এই মেট্রোলেরগুলোর দৈর্ঘ্য হবে ১২৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে উড়াল সড়কের দৈর্ঘ্য হবে ৬৭ কিলোমিটার এবং পাতাল রেলের দৈর্ঘ্য ৬১ কিলোমিটার। ঢাকা-আশুলিয়া মেট্রোরেল-১ প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। কয়েকটি প্রকল্পের সমীক্ষা চলছে। এই পুরো প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে পুরোপুরি বদলে যাবে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র।
মোট ৮টি প্যাকেজের আওতায় পুরো মেট্রোরেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ডিএমটিসিএল লাইন-৬ প্রকল্পের আওতায় মেট্রোরেল নির্মাণে মূল কাজ করবে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ইটালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের সহযোগিতা রয়েছে।
ঢাকার যানজট নিরসন ও নগরবাসীর যাতায়াত আরামদায়ক, দ্রুততর ও নির্বিঘœ করতে ২০১২ সালে গৃহীত হয় মেট্রোরেল প্রকল্প। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে এমআরটি-৬ নামের মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২০ সালের মধ্যে মেট্রোরেল চালু করার সিদ্ধান্ত থাকলেও বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মানুষের জীবনের মতো মেট্রোরেলের কর্মকাণ্ডেও সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। করোনার মধ্যেও প্রকল্পের কাজ চলাকালে প্রকল্পের ১ হাজারের বেশি কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রকল্পের কাজ দুই বছরের বেশি সময় পিছিয়ে পড়ে। করোনার পর আবার নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু হয়। উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার কাজ শেষে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন। এরই সঙ্গে মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। পরের দিন থেকে ঢাকাবাসী মেট্রোরেলে যাতায়াত শুরু করে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কমলাপুর পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের মক-আপ উত্তরা ডিপোতে এসে পৌঁছে। মকআপটি মেট্রোরেলের একটি বগির অর্ধেক অংশ মাত্র। এই মকআপ বগি দিয়ে কখনোই কোন যাত্রী পরিবহন করা হবে না। এটি এখন উত্তরার মেট্রোরেল মিউজিয়ামে প্রদশনীর জন্য রাখা আছে।
প্রকল্পের কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাপানে রেলকোচ নির্মাণকাজ শুরু হয়। কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম কোম্পানি লিমিটেড মেট্রোরেলের জন্য ২৪ সেট কোচ নির্মাণ করেছে। ডিএমটিসিএল আমদানি করা এই কোচগুলো দিয়েই এখন মেট্রোরেল যাত্রীসেবা দিয়ে যাচ্ছে। ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিতে মেট্রোরেল চলছে। উভয়দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচলের সক্ষমতা রয়েছে। ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করছে। প্রত্যেকটি ট্রেনে রয়েছে ৬টি করে কোচ।
মেট্রোরেলের কমলাপুর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে যাত্রীরা উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছবে। স্টেশনগুলো হলো উত্তরা-উত্তর, উত্তরা-সেন্টার, উত্তরা-দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণী, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিল। ১৬টি স্টেশনের মধ্যে ১৪টি স্টেশনে যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারছেন। চলতি মাসের শেষের দিকে বাকি দুইটি স্টেশন চালু হবে।
জাপানের আর্থিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এই প্রকল্পে আর্থিক সহযোগীতা করেছে। এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। তবে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায়। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার সম্প্রসারণে খরচ বেড়েছে। ২৪ সেট ট্রেনের দাম ৪ হাজার ২৫৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। সাড়ে ৯ ফুট চওড়া স্টেইনলেস স্টিল বডির কোচগুলোতে লম্বাভাবে দুই পাশে সিট রয়েছে। বেশির ভাগ যাত্রীই দাঁড়িয়ে যাতায়াত করে। প্রতিটি ট্রেনের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা হবে ১ হাজার ৭৩৮ জন।
মেট্রোরেল পুরোপুরি অত্যাধুনিক ও বিদ্যুৎচালিত বাহন। মেট্রোলাইনে লোডশেডিং এড়াতে নিজস্ব বৈদ্যুতিক প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। সব ধরনের গেট খোলা ও বন্ধ হওয়া, সংকেত ও সব ধরনের যোগাযোগ স্থাপনসহ ১৭ থেকে ১৮টি ব্যবস্থায় মেট্রোরেল চলাচলসহ নিজস্ব বিদ্যুতায়নে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে।
জাইকার বিখ্যাত নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘কাওয়াসাকি মিৎসুবিশি কনসোটিয়ামের’ নিজস্ব কারখানায় অত্যাধুনিক কোচগুলো তৈরি হচ্ছে। কোচগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রঙয়ের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নৌপথে কোটচগুলো জাপান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হবে। নতুন এই ট্রেন চালানোর জন্য লোকজনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। মোট ২৪ জোড়া অর্থাৎ ৪৮টি কোচ মেট্রোরেলে চলাচল করবে।
সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসন এবং গণপরিবহনের সক্ষমতা বাড়াতে ছয়টি মেট্রোরেল রুট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর আওতায় নির্মাণ করা হবে ১২৮ কিলোমিটার রুট, যার ৬৭ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে এবং ৬১ কিলোমিটার হবে পাতালপথে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, যানজট নিরসনে মেট্্েরারেল বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। তবে এখনই সব মানুষ মেট্রোরেলের সুবিধা পাবে না এবং শহরের যানজট কমানো সম্ভব হবে না। মেট্রোরেলের পরিপূর্ণ একটি নেটওয়ার্ক যখন চালু হবে তখন মূল্যায়ন হবে। মেট্রোরেলের কাছাকাছি বসবাসরত বাসিন্দারা অবশ্যই যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য ও নির্ভরতা পাবেন। কম সময়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবেন। এছাড়া মেট্রোরেলে আসা-যাওয়ার জন্য শার্টল বাসরুটের সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় এমআরটি পুলিশ নামে পুলিশের একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। ৩৫৭ জনবলের এই ইউনিটের দায়িত্বে থাকবেন ডিআইজি পদমর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তা।