নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। এর ছয় মাসের মধ্যেই দেশ পুনর্গঠনে হাত বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন বন্ধু দেশ। এবারের বিজয় দিবস উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্ব
চারদিকে নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ। অবকাঠামো বলতে কিছুই নেই। উৎপাদন কমছে কৃষিতে। উপকরণসহ নানা সংকটে শিল্পে উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে। মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব চরমে। সবখানে জেঁকে বসেছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কশাঘাত। কঠিন সে মুহূর্তে পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারকে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানা মাত্রায় সহায়তাও মিলেছে সে সময়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছিল খাদ্য সংকট। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে চালের উৎপাদন কমেছিল ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ। কৃষি উৎপাদন হ্রাস ও বাণিজ্যিক অবকাঠামোর সংকটে কমে গিয়েছিল পাট ও চায়ের মতো প্রধান অর্থকরী ফসলগুলোর রফতানি। এর মধ্যে চা রফতানি কমেছিল ৬৫ শতাংশ। পাটের ক্ষেত্রে এ হার ছিল প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ।
এ পরিস্থিতিতে বিদেশী সহায়তা ও অনুদান ছাড়া যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল বলে বিভিন্ন সময় তৎকালীন নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য ও দেশী-বিদেশী সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৬৯৭ মিলিয়ন (৬৯ কোটি ৭০ লাখ) ডলারের ত্রাণ-অনুদান ও ঋণ সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে শীর্ষ দাতাদেশগুলোর তালিকায় সে সময়ে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম দুই মিত্র ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি নাম ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরও। সে সময় শুধু এ তিন দেশ থেকেই এসেছে ৪৮৫ মিলিয়ন (সাড়ে ৪৮ কোটি) ডলার। প্রয়োজনের চরমতম মুহূর্তে পাওয়া সে অর্থই হয়ে উঠেছিল সরকারের পুনর্গঠন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রধান হাতিয়ার। দেশের প্রথম বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৭৫ শতাংশই সাজানো হয়েছিল বিদেশী অনুদান ও সহায়তার ওপর নির্ভর করে।
১৯৭২ সালের জুন পর্যন্ত পাওয়া অনুদান ও সহায়তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এসেছিল প্রতিবেশী ভারত থেকে। নগদ অনুদান থেকে শুরু করে বাণিজ্য চুক্তিসহ নানাভাবেই বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল দেশটি। ১৯৭২ সালে দেশটি বাংলাদেশে ২৬৭ মিলিয়ন (২৬ কোটি ৭০ লাখ) ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর মধ্যে ২১৭ মিলিয়ন (২১ কোটি ৭০ লাখ) ডলার জুন পেরোনোর আগেই হাতে পেয়ে যায় বাংলাদেশ। ওই বছরে বাংলাদেশে সহায়তার জন্য সাড়ে সাত লাখ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করেছিল ভারত। এর মধ্যে চার লাখ টন আসে জুনের মধ্যে। ত্রাণ-অনুদানের পাশাপাশি আরো নানাভাবে বাংলাদেশের পাশে ছিল ভারত। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও গঠন হয়েছিল ভারতের কাছ থেকে পাওয়া সফট লোনের ভিত্তিতে। এমনকি বাংলাদেশের প্রথম মুদ্রিত নিজস্ব মুদ্রাও ছাপানো হয়েছিল ভারতে।
বড় অংকের সহায়তা এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকেও। ১৯৭২ সালের প্রথম ছয় মাসে ২১৬ মিলিয়ন (২১ কোটি ৬০ লাখ) ডলার সহায়তা দিয়েছিল দেশটি। পরে সহায়তার মাত্রা বাড়াতে বাড়াতে ১৯৭৩ সালের মধ্যেই দাতাদেশ হিসেবে শীর্ষে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্র।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধ পক্ষে। স্বাধীনতার পর দেশটির বাংলাদেশ নীতিতে এ আমূল পরিবর্তন প্রসঙ্গে ১৯৭৩ সালের ১০ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্পর্কের তিক্ততাকে মুছে ফেলতে বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ দাতাদেশ হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭৩ সালের মার্চের মধ্যেই বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সহায়তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১৮ মিলিয়ন (৩১ কোটি ৮০ লাখ) ডলারে।
সে সময় এক তরুণ মার্কিন নাগরিক সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশী অনেকের কাছেই আমাদের পক্ষ থেকে অর্থ দেয়ার বিষয়টি বোধগম্য না। দুই বছর আগেও তারা আমাদের বৈরী হিসেবেই দেখেছে।’
বাংলাদেশী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি সম্পর্কে খুবই বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের হইচই না করেই তারা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় দাতা হয়ে উঠেছে।’
স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালের মার্চের শুরুর দিকে পাঁচদিনের সফরে মস্কো যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ওই সফর চলাকালে বাংলাদেশকে ৫২ মিলিয়ন (৫ কোটি ২০ লাখ) ডলার ত্রাণ ও উন্নয়ন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। জুনের মধ্যেই এ অর্থ পেয়ে যায় বাংলাদেশ। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের ফ্যাক্টরি ও রেডিও ট্রান্সমিটার নির্মাণে এ অর্থ ব্যয় হয়। সেই সঙ্গে স্বাধীনতার ১০ বছর আগে বাংলাদেশে শুরু করা জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দেয় দেশটি। এছাড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন সহায়তা হিসেবে পরে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
শিল্প উৎপাদনের দিক থেকে সে সময় মারাত্মক বিপত্তিতে ছিল বাংলাদেশ। জ্বালানি, কাঁচামাল, বিদ্যুৎসহ উৎপাদন উপকরণের সংকট দিনে দিনে বাড়ছিল। ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছিল অর্ধেকে। শুরুর পাঁচ মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় সবগুলো কাপড়ের কল। একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় এক-পঞ্চমাংশ পাটকল। এ অবস্থায় আমদানি ও সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য বাণিজ্য অবকাঠামোগুলোকে দ্রুত সচল করে তোলার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বন্দর ও এর আশপাশে অসংখ্য নৌ-মাইন স্থাপন করে রেখেছিল পাকিস্তানিরা। এতে বন্দরে জাহাজ ভেড়া দূরের কথা, এর আশপাশেও নৌচলাচল হয়ে পড়েছিল অসম্ভব। আবার বন্দরের ১৮টি মুরিং বা নোঙর করার স্থানের মধ্যে ১২টিই যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে পড়েছিল।
এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে দুই বছর ধরে মাইন অপসারণ কার্যক্রম চালায় সোভিয়েত নৌবাহিনীর একদল নাবিক ও প্রকৌশলী। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে মাইন অপসারণ কার্যক্রম শুরু হয়। আট শতাধিক সোভিয়েত নৌ-সেনার প্রচেষ্টায় তিন মাসের মধ্যেই বন্দর কার্যক্রম শুরুর উপযোগী হয়ে ওঠে। তবে বন্দরকে পুরোমাত্রায় সচল করতে তাদের প্রয়াস চালাতে হয়েছে ১৯৭৪ সালের জুন পর্যন্ত। বন্দরটিকে সচল করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ইউরি রেডকিন নামে এক সোভিয়েত নাবিক।
ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশও বাংলাদেশের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রথম ছয় মাসের মধ্যে কানাডা থেকে সহায়তা এসেছিল ৪৫ মিলিয়ন (সাড়ে ৪ কোটি) ডলার। ২৭ মিলিয়ন (২ কোটি ৭০ লাখ) ডলার এসেছিল সুইডেন থেকে। নরওয়ে দিয়েছিল ১২ মিলিয়ন (১ কোটি ২০ লাখ) ডলার। এছাড়া জাপান ১১ মিলিয়ন (১ কোটি ১০ লাখ), যুক্তরাজ্য ৯ মিলিয়ন (৯০ লাখ) ও ফ্রান্স ৪ মিলিয়ন (৪০ লাখ) ডলার সহায়তা দিয়েছিল। সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের দেশগুলোর মধ্যে যুগোস্লাভিয়া থেকে সহায়তা এসেছিল ৭ মিলিয়ন (৭০ লাখ) ডলারের। এর বাইরেও অন্যান্য দেশ থেকে ৯৭ মিলিয়ন (৯ কোটি ৭০ লাখ) ডলার সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।