২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৮:৩৬:১২ অপরাহ্ন


মানুষ কুলিয়ে উঠতে পারছে না
অর্থনীতি ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৯-২০২৩
মানুষ কুলিয়ে উঠতে পারছে না ছবি: সংগৃহীত


কোনো জরিপ না করেই বলা যায়, বর্তমানে দেশের প্রধান সমস্যা দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি। সাম্প্রতিক একটি জরিপের ফলাফলও তাই। এশিয়া ফাউন্ডেশন এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত দেশব্যাপী ১০ হাজার মানুষের ওপর এক জরিপে ৯৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামবৃদ্ধি তাদের জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, এই প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক।

জরিপটি করা হয় গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে। তখন সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ শতাংশের কাছাকাছি। এখন তা প্রায় ১০ শতাংশ। ফলে বাজারের উত্তাপ এবং টিকে থাকার কষ্ট এখন আরও বেড়েছে। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দরের সঙ্গে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ কুলিয়ে উঠতে পারছে না। গরিব ও  নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর জিনিসপত্রের বাড়তি দামের চাপ আরও বেশি। কেননা তাদের ব্যয়ের বেশির ভাগ অংশ খাদ্য কিনতে ব্যয় হয়। বিবিএসের সর্বশেষ  হিসাবে আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা প্রায় একযুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।

দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ নীতিনির্ধারকরা কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারকে দায়ী করছেন।

কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারদর পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম কম। সর্বশেষ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক মূল্যসূচক দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমতে থাকায় এবং এর সঙ্গে নিজেদের ব্যবস্থাপনার দক্ষতার মাধ্যমে অনেক দেশ সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। বাংলাদেশে কমছে না, বরং বাড়ছে। চরম সংকটে পড়ে শ্রীলঙ্কার  মূল্যস্ফীতি  এক বছর আগে ৭০ শতাংশে উঠেছিল। গত জুলাই মাসে তাদের মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে পেরেছে। যারা মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে, তাদের বেশির ভাগই বাজারে চাহিদা কমানোর পদক্ষেপ নিয়ে বিশেষত সুদের হার বাড়িয়ে এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। বাংলাদেশেও গত মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর আগে থেকেই আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ ছিল। সরকারের ব্যয় সংকোচনেরও নানা উদ্যোগ ছিল। তারপরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। বাজারে একেক সময় একেক পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে মানুষের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সম্প্রতি এমন পণ্যের মধ্যে রয়েছে আলু, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি। 

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। বিবিএসের পরিসংখ্যানের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন গবেষণা বলছে, সমাজের বেশির ভাগ মানুষের আয়ের তুলনায়  ব্যয় বেড়েছে। আর যারা বেকার, তাদের জীবিকা নির্বাহের কষ্ট-কর্মে নিয়োজিতদের চেয়ে যে অনেক বেশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিভিন্ন জরিপের ফলাফল বলছে, অল্প আয়ের মানুষের মজুরি বা বেতন অল্প সময়ের মধ্যে খুব একটা বাড়ে না। কারও কারও ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিরূপ পরিস্থিতির কারণে কমেও যায়। অথচ অল্প সময়ের মধ্যে কোনো কোনো পণ্যের ও সেবার দাম অনেক বেড়ে যাচ্ছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালে কিংবা কোনো পণ্যের শুল্ক বাড়লে কিংবা আমদানি উৎসে কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিলে সঙ্গে সঙ্গে দাম অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হওয়া যার অন্যতম উদাহরণ।

গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কামাল মুজেরী বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি জুলাইয়ের চেয়ে আগস্টে ২ দশমিক ৭৮ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি খুব বেশি নয়। এমনকি  আশপাশের দেশ শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা এখনও বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে এখন আর বিশ্ববাজারের দোহাই দেওয়া যাবে না। নিজস্ব নীতির ব্যর্থতার কারণেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিতিশীল বিরাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ হার যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিও কাজে আসছে না।

বিআইডিএসের এই সাবেক মহাপরিচালকের মত ,বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা মূল্যস্ফীতিকে আরও প্রকট করে তুলছে। কয়েক দিন পর পর কিছু নিত্যপণ্যের দাম অনেকটা বিনা কারণে হঠাৎ আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত  সংস্থাগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ সুযোগে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী জনগণের কাছ থেকে অতি উচ্চমূল্য নিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। নীতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অতএব মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

মজুরির অবস্থা: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি মজুরি সূচকও প্রকাশ করে। এ সূচকের প্রবণতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জিনিসপত্রের দাম এবং মজুরি বৃদ্ধির হারে পার্থক্য বাড়ছে। এ বছরের শুরুর দিকে  মূল্যস্ফীতি বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি বৃদ্ধির হার তার চেয়ে কম থাকলেও কাছাকাছি ছিল। কিন্তু কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি হারে। গত জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। সর্বশেষ আগস্টে মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ, যা খাদ্য মূল্যস্ফীতির চেয়ে ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কম। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ৬৩টি পেশার নিম্ন মজুরির দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক যারা দৈনন্দিন মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন, তাদের আয়ের ওপর জরিপ করে বিবিএস এ পরিসংখ্যান তৈরি করে।

মানুষ যেভাবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে: গবেষণা সংস্থা সানেম গত মার্চ মাসে দেশব্যাপী একটি জরিপ করে, যার বিষয় ছিল– মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের গরিব মানুষের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে। আট বিভাগের ১ হাজার ৬০০ মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, আগের ছয় মাসে শহর এলাকার দরিদ্রদের খাদ্য কেনার ব্যয় বেড়েছে ১৯ শতাংশ। আর গ্রামে বেড়েছে ১৫ শতাংশ। অথচ এ সময়ে তাদের আয়ে তেমন পরিবর্তন হয়নি। এ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে ৯০ শতাংশ মানুষ খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। তারা তুলনামূলক কম দামের পণ্য কিনে জীবনধারণ করছেন। তারা মাছ-মাংস বা আমিষ জাতীয় পণ্য কেনা কমিয়েছেন। এর মানে পুষ্টির সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি আপস করতে হচ্ছে তাদের। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে তাদের ধার করতে হচ্ছে। সঞ্চয় ভেঙেছেন ৩৫ শতাংশ উত্তরদাতা। সূত্র: সমকাল