পর্বত জয় করতে নয়, নিজেদের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে বেরিয়েছিল তাঁরা। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, তুষারাবৃত এভারেস্টের মাথায় তখনও পা পড়েনি মানুষের। শুধু জল্পনাকল্পনাই সার। ৮৮৪৮ মিটারের সেই আশ্চর্য উন্নাসিক পাহাড় জয় করার স্বপ্ন নিয়েই সুদূর নিউজিল্যান্ড থেকে ছুটে গেছিলেন এক ঋজু, হার-না-মানা মানুষ, এডমন্ড হিলারি। যতদিন মানুষের বিস্ময় থাকবে, নতুনকে চেনার নেশা থাকবে মনে, ততদিন অভিযাত্রীদের বিশ্বকোষে এই দীর্ঘকায় অসমসাহসী মানুষটির (Edmund Hillary) নাম লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে।
আজ থেকে ঠিক একশো এক বছর আগে, ১৯১৯ সালের ২০শে জুলাই নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড শহরে পার্সিভাল অগস্টাস হিলারি ও গারট্রুড ক্লার্কের ঘর আলো করে এল নবজাতক, নাম দেওয়া হল এডমন্ড। হিলারিরা জাতে ইংলিশম্যান। পরিবারের আগের প্রজন্ম উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার থেকে এসে নিউজিল্যান্ডের ওয়াইরোয়া নদীর ধারে বসতি গড়ে তোলেন। গ্যালিপলির যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন পার্সিভাল। তারই সম্মানদক্ষিণা হিসাবে তাঁকে নিউজিল্যান্ডের টুয়াকাউ অঞ্চলে বসবাসের জমি দেওয়া হলে সপরিবারে সেখানেই চলে আসেন হিলারি পরিবার। মৌমাছি চাষ করে মধু উৎপাদন করে সংসার চলত। কিন্তু মা গারট্রুড স্বপ্ন দেখতেন ছেলে এডমন্ড একদিন মস্ত মানুষ হবে। দেশে-বিদেশে নাম ছড়িয়ে পড়বে তার। সে জন্য ছেলের পড়াশোনার দিকে বিশেষ নজরদারি ছিল মায়ের।
ছোট্ট এডমন্ডকে প্রথমে ভর্তি করা হল টুয়াকাউ নার্সারি স্কুলে। সেখানে প্রাথমিক পড়াশোনার পর অকল্যান্ড গ্রামার স্কুল থেকে হায়ার স্টাডি। ছেলেবেলায় ছাত্র হিসাবে এডমন্ড যে দারুণ মেধাবী ছিলেন, তা বলা যায় না। বরং একরকম লাস্টবেঞ্চারই ছিলেন। উঁচু ক্লাসে গিয়ে পড়লেন ভারি সমস্যায়। একে পড়াশোনার চাপ, তার উপর প্রতিদিন দীর্ঘ ট্রেন জার্নি। স্কুলে যাওয়ার জন্য সকাল ৭টায় বেরিয়ে সাইকেল চালিয়ে টুয়াকাউ স্টেশনে যেতে হত রোজ। সারাদিনের ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে।
গতানুগতিক পড়াশোনা চলছিল, তার মধ্যেই হঠাৎ করে এক অভাবনীয় সুযোগ এল এডমন্ডের জীবনে। ১৬ বছর বয়সে স্কুল থেকেই ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হল মাউন্ট রুয়াপেহু পর্বতে ভ্রমণে। স্বভাবে লাজুক এডমন্ডের বন্ধুবান্ধব ছিল না বিশেষ। স্কুলের এই শিক্ষামূলক ভ্রমণে এসে তাঁর সামনে যেন নতুন এক পৃথিবীর দরজা খুলে গেল। অতখানি উচ্চতায় তুষার শুভ্র প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রথম তাঁর নিজেকে অশেষ মনে হল, মনে হল নতুন মানুষ।
স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে অঙ্ক ও বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ক্লাসে ভর্তি হন এডমন্ড। সেই সঙ্গে ওখানকার ট্রাম্পিং ক্লাবেরও সদস্য হয়ে ওঠেন। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা, বেতের মতো ঋজু শরীর আর দুর্দান্ত ফিটনেস- আদর্শ পর্বতারোহী হওয়ার সমস্ত গুণই ছিল তাঁর মধ্যে। ১৯৩৯ সাল নাগাদ সুযোগও এসে গেল দক্ষিণ আল্পস পর্বতমালার মাউন্ট অলিভিয়ার পর্বতশৃঙ্গ অভিযানে অংশ নেওয়ার। এডমন্ডের জীবনের প্রথম শৃঙ্গজয় এই অলিভিয়াতেই।
কিন্তু শুধু পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ালে তো আর সংসার চলবে না। তাই পড়াশোনায় ইতি টেনে কিছুটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়েই বাবা আর ভাই রেক্সের সঙ্গে এডমন্ডও যোগ দিলেন মৌমাছি প্রতিপালনের পারিবারিক ব্যবসায়। সারা গ্রীষ্মকালটা এইসব ব্যবসার কাজে কেটে যেত তাঁর। আর টাকা জমিয়ে শীতকালে ছুটতেন পাহাড়ে-পাহাড়ে।
অভিযানের নেশায় এডমন্ড বুঁদ তখন। দুচোখে সারা পৃথিবী ঘুরে দেখার স্বপ্ন। কিন্তু এর মধ্যেই শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এসময় মিত্রশক্তির পক্ষে রয়্যাল নিউজিল্যান্ড এয়ারফোর্স সি-প্লেনের নেভিগেটর হিসাবে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিলেন এডমন্ড।
যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৫ নাগাদ তাঁকে ফিজি আর সলোমন দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো হলে সেখানেই এক দুর্ঘটনায় বিশ্রীভাবে আগুনে ঝলসে যান। ১৯৪৫ এর আত্মসমর্পণ চুক্তির পর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই সুস্থ হয়ে আবার পাহাড়ের কাছেই আশ্রয়ের খোঁজে ফিরে এলেন হিলারি।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি নাগাদ আরও বেশ কয়েকজন পর্বতারোহীর সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ শিখর ‘মাউন্ট কুক’-এ আরোহণ করেন হিলারি। সে বছরই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সহকর্মী বন্ধু নরম্যান হার্ডির। তার পরের বছর, মানে ১৯৪৯ সাল নাগাদ তিব্বতের ভিতর দিয়ে এভারেস্ট যাওয়ার প্রচলিত পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন এভারেস্ট অভিযানের জন্য নেপালের ভিতর দিয়ে যাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় পথ রইল না। নেপাল থেকেও অভিযানের অনুমোদন পাওয়া ছিল বিরাট ঝক্কির ব্যাপার। বছরে দুটো-একটা অভিযাত্রী দল ছাড়া ছাড়পত্র মিলত না কারও। এভারেস্ট তখনও অধরা মাধুরী। দূর থেকে হাতছানি দিলেও মানুষের সাধ্য হয়নি তার মাথার উপর বিজয়কেতন ওড়ানোর।
১৯৫২ শুরুতেই এক সুইস অভিযাত্রীর দল এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে বিফল হয়। খারাপ আবহাওয়ার দরুণ সামিট পয়েন্টের মাত্র ৮০০ ফুট দূর থেকে ফিরে আসতে হয় তাঁদের। পরের বছর মানে ১৯৫৩ তে জন হান্টের নেতৃত্বে ব্রিটিশ অভিযাত্রীর আরেক দল এভারেস্ট অভিযানের পরিকল্পনা নিলে এডমন্ড হিলারি তাঁর বন্ধু জর্জ লোয়িকে নিয়ে সেই দলে নাম লেখালেন। দশ হাজার পাউন্ড মালপত্র, ৩৬২ জন কুলি আর ২০ জন শেরপা সহ চারশতাধিক অভিযাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক এক্সপিডিশন।
মার্চ মাসে বেস ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে ধীরে ধীরে দলটি ৭,৮৯০ মিটার উঁচুতে উঠে সাউথ কলে ক্যাম্প ফেলে। এই সাউথ কল বা দক্ষিণের পথটি তার আগের বছরই আবিষ্কার করেছিলেন সুইস অভিযাত্রীরা। বেসক্যাম্পে ঢোকার মুখে প্রকৃতির সেই ভয়াল সুন্দর রূপের সামনে সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন এডমন্ড। পাহাড়ে তিনি আগেও চড়েছেন, কিন্তু মাউন্ট এভারেস্টের সৌন্দর্যের সঙ্গে কোনওকিছুরই যেন তুলনা চলে না। সারাজীবন দেওয়া অজস্র সাক্ষাৎকারে সে কথা বারবার বলে গেছেন এডমন্ড।
এলোমেলো বাতাস আর তুষারঝড়, পদে পদে বরফে পা পিছলোনোর ভয়, তার মধ্যেই পা টিপে টিপে পথ চলা। ২৬ মে টম বুর্দিলঁ ও চার্লস ইভান্স প্রথম চেষ্টা করলেন শৃঙ্গজয়ের। কিন্তু ইভান্সের অক্সিজেন সিলিন্ডারে গন্ডগোল দেখা দেওয়ায় মূল শৃঙ্গের ৩০০ ফুট নীচ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয় তাঁরা। এর পর এল তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারির পালা। সাউথ কলে তুষারঝড়ে আটকে পড়ায় দুটো মূল্যবান দিন ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়েছে তাঁদের। ২৮শে মে ৮৫০০ মিটার উঁচুতে বহু কষ্টে তাঁবু ফেলা গেল। সেখানেই তাঁদের রেখে নীচে ফিরে গেলেন আং নিমা, আলফ্রেড গ্রেগরি ও জর্জ লোর।
কোনওভাবে রাতটা কাটল। কিন্তু সকালে উঠে এডমন্ড দেখলেন সারারাত বরফ পড়ে তাঁদের জুতো জমে পাথর। অভিযান হবে কী করে? প্রায় দু’ঘণ্টার চেষ্টায় সে জুতো সারিয়ে নতুন করে শুরু হল পথ চলা। কিন্তু সামনেই চল্লিশ ফুটের খাড়া দেওয়াল। একবার পা ফসকালে কী হবে তা দুজনেই জানেন। কিন্তু থেমে গেলে তো চলবে না। দেওয়ালের একটা ফাটলে নজর গেল এডমন্ডের। প্রথমে পা বাড়ালেন তিনিই, ইশারায় অনুসরণ করতে বললেন তেনজিংকে। পথে পথে পায়ের নীচে শীতল বরফের মৃত্যুফাঁদ। এই ঠান্ডায় অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকেও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবু কী এক আশ্চর্য ঘোরের ভিতর পথশ্রমের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চললেন দুজনে।
ঠিক সকাল ১১:৩০ মিনিটে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অজয় অক্ষয় হিমালয়ের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গের মাথায় পা রাখলেন হিলারি আর তেনজিং। রচিত হল নতুন ইতিহাস। হাতের আইস অ্যাক্স তুলে ছবি তুললেন তাঁরা। চকোলেট প্রসাদ দিলেন দেবাত্মা হিমালয়ের উদ্দেশ্যে।
এভারেস্ট অভিযান থামেনি আজও। এখনও প্রতি বছর অজানা আকর্ষণে সম্মোহিতের মতো অভিযাত্রীরা ছুটে আসেন দেশ-বিদেশ থেকে এই দুর্গম তুষারাচ্ছাদিত পথে। কেউ কেউ লক্ষ্যে পৌঁছন, কেউ বা হারিয়ে যান, ঘুমিয়ে পড়েন বরফের চাদর মুড়ে। তবু এভারেস্টের সঙ্গে যে দু’টো নাম চিরকালের মতো জুড়ে গেছে, তার অন্যতম নামটিই এডমন্ড হিলারি।