বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও রিমান্ড মঞ্জুরের বিষয়ে নীতিমালা করে দিয়েছিলো দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য দেওয়া ওই নীতিমালার বিষয়ে ফের আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন।
বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন: বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি বোরহান উদ্দিন, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন।ফের আপিল শুনানির বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ৬টি আইনগত যুক্তিতে লিভ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। রিভিউতে লিভ দেওয়া মানে ফের আপিল শুনানি হবে। আপিল বিভাগ যে নীতিমালা করে দিয়েছিলো সেগুলো সঠিক আছে কিনা আপিল শুনানিতে তা আদালত দেখবেন। তবে আপিল বিভাগের রায় স্থগিত করেনি।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ (বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার) ও ১৬৭ (রিমান্ড) ধারা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৪ মে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য পৃথক পৃথক নীতিমালা করে দিয়েছিলো তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ। সেই রায় পুন:বির্বেচনা চেয়ে রিভিউ পিটিশন দায়ের করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
রিভিউর শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আপিল বিভাগ ৫৪ ধারা প্রতিপালনের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কিছু নীতিমালা করে দিয়েছে। আমরা মনে করি এই নীতিমালার কয়েকটি বিষয় দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের নীতিমালায় বলা হয়েছে, গ্রেফতারের পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা গ্রেফতারের একটি স্মারকপত্র তৈরি করবেন এবং এতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির স্বাক্ষর, তারিখ লিপিবদ্ধ থাকবে। গ্রেফতারের পর ১২ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই তার কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, তা না পাওয়া গেলে ঐ ব্যক্তির পরামর্শে কোনো বন্ধুকে গ্রেফতারের স্থান এবং হেফাজতে রাখার বিষয়টি অবহিত করবেন। নীতিমালার এসব বিষয় বাস্তবায়ন করা কতটা সম্ভব তা পর্যালোচনার সময় এসেছে। কারণ আসামি গ্রেফতার করে তার স্বজনদের অবহিত করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বা সাক্ষীকে অনেক সময় হামলার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, আপনারা কেন সাক্ষী সুরক্ষার আইন করছেন না। যেখানে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই সাক্ষী সুরক্ষার আইন করার উপর রায় দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের আপিল খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। আপিল খারিজ মানে হাইকোর্টের রায় বহাল হওয়া। কিন্তু সেটা না করে আপিল বিভাগ রায় সংশোধন করে পৃথক পৃথক নীতিমালা করে দিয়েছে। তিনি বলেন, আইন প্রণয়নের দায়িত্ব সংসদের। আদালত সংসদকে কি আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিতে পারেন?
রিটকারী পক্ষের কৌসুলি ব্যারিস্টার অনীক আর হক বলেন, হাইকোর্ট সিআরপিসির এই দুটি ধারার বিষয়ে যে রায় দিয়েছিলো তা সংশোধন করে আপিল বিভাগ নীতিমালা করে দিয়েছে। যখন কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা হয় তখন তার স্বজনদের জানানো সভ্য দেশের উদাহরণ। শুনানি শেষে ৬টি আইনগত যুক্তিতে আট বছর পর ফের আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
প্রসঙ্গত ১৯৯৮ সালে ঢাকায় ডিবি হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেল। ঐ ঘটনায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর দায়েরকৃত এক রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে ১৬৭ ধারার বিধান সংশোধনের নির্দেশনা দেয়। এ-সংক্রান্ত আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত একগুচ্ছ নির্দেশনা মেনে চলার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের জন্য পৃথক নীতিমালা করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ পিটিশন দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ।