দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আনার কার্যক্রম চলতি মাসের শেষ কিংবা আগামী মাসেই উদ্বোধন করা হবে। এ ধরনের বড় উদ্যোগের ক্ষেত্রে সাধারণত পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো হলেও এ কার্যক্রম উদ্বোধনের দিন থেকেই দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ অংশ নিতে পারবেন। মাসিক পেনশন-সুবিধা পেতে ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে।
১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যে কেউ পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারবেন। ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাওয়া যাবে। ৫০ বছরের অধিক বয়সীরাও এতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। তবে অন্যদের মতো ৬০ বছর বয়স থেকেই পেনশন সুবিধা পাবেন না তাঁরা। ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর তাঁরা পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। পেনশনধারী ৭৫ বছর বয়স হওয়ার আগে মারা গেলে তাঁর নমিনি মাসিক পেনশন পাবেন। এ ছাড়া ১০ বছর ধরে চাঁদা দেওয়ার শর্ত পূরণের আগেই কেউ মারা গেলে মুনাফাসহ তাঁর নমিনিকে জমা অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, যাঁরা পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে চান, তাঁদের অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। ঘরে বসে যাতে সবাই রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন, সেজন্য একটি অ্যাপ থাকবে। এ ছাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়েও নিবন্ধন করা যাবে। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে অ্যাপ ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে প্রত্যেককে ১৮ সংখ্যার ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর দেওয়া হবে।
সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলবে। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে তাঁর নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট নম্বরে মাসিক চাঁদা দিতে হবে। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে চাঁদা দিতে পারবেন। সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কিংবা বিকাশ, নগদসহ যে কোনো মোবাইল আর্থিক সেবাদাতার মাধ্যমে ওই অ্যাকাউন্টে চাঁদা দেওয়া যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত করা পেনশন বিধিমালায় সরকারি চাকরি ও পেনশন ব্যবস্থায় যাঁরা অন্তর্ভুক্ত নন, প্রাথমিকভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় এমন চারটি শ্রেণিকে যুক্ত করা হচ্ছে।
তাঁরা হলেন– বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী, প্রবাসী বাংলাদেশি, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী এবং অসচ্ছল ব্যক্তি। বেসরকারি চাকরিজীবী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের জন্য পেনশনের চাঁদার হার মাসিক ১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। অসচ্ছল ব্যক্তির মাসিক চাঁদা ১ হাজার টাকা। এর মধ্যে অসচ্ছলদের জমা দিতে হবে ৫০০ টাকা, বাকি ৫০০ টাকা সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হবে। প্রবাসীদের মাসিক চাঁদা সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া সাড়ে ৭ হাজার টাকা এবং ১০ হাজার টাকার দুটি স্কিমও থাকবে তাঁদের জন্য। তবে প্রবাসীদের বিদেশি মুদ্রায় এ চাঁদা দিতে হবে। পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হলে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন তাঁরা। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী যদি ৫ হাজার টাকার স্কিমে যোগ দেন, তাহলে তাঁর প্রকৃত চাঁদা হবে ৪ হাজার ৮৭৫ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া নাগরিকদের জমা দেওয়া চাঁদার বিপরীতে ৮ শতাংশ হারে সুদ দেবে সরকার। সে হিসাবে কেউ যদি ১৮ বছর বয়সে পেনশন হিসাবে ১ হাজার টাকা করে ৬০ বছর পর্যন্ত মাসিক চাঁদা জমা দেন, তাহলে তিনি প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা হারে পেনশন পাবেন। আবার কেউ যদি ৩০ বছর বয়সে ১ হাজার টাকা মাসিক চাঁদা জমা শুরু করেন, তাহলে ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর মাসে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পাবেন।
জনগণের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে সেই চাঁদার অর্থ সুদসহ জনগণকে ফেরত দেওয়া হবে, তাহলে পেনশনের আওতায় সরকার জনগণকে কী দিচ্ছে– এ প্রশ্নে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বিভিন্ন উন্নত দেশ যেভাবে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে, বাংলাদেশও সে পথেই এগোচ্ছে। পেনশন তহবিল সরকার কোনো লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে মুনাফার একটা নির্দিষ্ট হারে সুদ, আসলসহ অবসরের সময় ফেরত দেবে। এটাই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তবে অসচ্ছল ব্যক্তিদের চাঁদার একটি অংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। শিগগির সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে গঠিত কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ দেওয়া হবে। সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ভবনের কোনো একটি তলায় তাঁদের দাপ্তরিক কার্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সম্পর্কিত আইন প্রণয়নে বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের পর এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার রক্ষায় ঢাকঢোল পিটিয়ে হয়তো দ্রুত এ ব্যবস্থার উদ্বোধন করা হবে। তবে এত অল্প সময়ে এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। উদ্যোগটা খুব ভালো কিন্তু অনেক বড় কর্মযজ্ঞ হওয়ায় আরও প্রস্তুতি দরকার। উন্নত দেশে নিম্ন আয়ের জনগণের চাঁদা সরকার বহন করে। অনেক লোকের চাঁদা দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের জন্য সরকার কী করবে? তাই কর্তৃপক্ষের জনবল নিয়োগের পর অন্তত তিন থেকে চার বছর বিভিন্ন দেশের এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পর্যালোচনা করে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা উচিত।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, সরকারি চাকরিজীবী এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা বর্তমানে সরকার থেকেই পেনশন, গ্র্যাচুইটিসহ অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন। তাঁদের জন্য বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থাই চালু থাকবে। তবে কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় থেকে যাঁরা সরকারি চাকরিতে ঢুকবেন, তাঁদের এখনকার মতো সরকার থেকে পেনশন পাওয়ার বদলে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আনার বিষয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একটি ঘোষণা থাকতে পারে। এ ছাড়া সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর অন্তত পাঁচ বছর তা ঐচ্ছিক রাখা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হতে পারে।