আত্মত্যাগের অনন্য ইবাদত কোরবানি। এ কোরবানির পশুর গোশত নিজে খাওয়া ও অন্যকে দেওয়াও ইবাদত। কোরবানির গোশত নিজে খাওয়া ও অন্যকে দেওয়ায় রয়েছে কোরআনের নির্দেশনা। এ সম্পর্কে কোরআনুল কারিমের একাধিক আয়াতে এসেছে-
১. لِّیَشۡهَدُوۡا مَنَافِعَ لَهُمۡ وَ یَذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰهِ فِیۡۤ اَیَّامٍ مَّعۡلُوۡمٰتٍ عَلٰی مَا رَزَقَهُمۡ مِّنۡۢ بَهِیۡمَۃِ الۡاَنۡعَامِ ۚ فَکُلُوۡا مِنۡهَا وَ اَطۡعِمُوا الۡبَآئِسَ الۡفَقِیۡرَ
‘যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে আর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেওয়া চতুস্পদ জন্তু জবাই করার সময়। এরপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।‘ (সুরা হজ : ২৮)
আয়াতে ‘গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু’ বলতে উট, গরু, ছাগল ও ভেড়াকে বোঝানো হয়েছে। এদের উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার অর্থ- এদের জবাই করা, যা আল্লাহর নাম নিয়েই করা হয়। আর ‘বিদিত দিনগুলো’ বলতে জবাইয়ের দিনগুলো; অর্থাৎ তাশরিকের দিনসমূহকে বোঝানো হয়েছে।
সুতরাং জবাইয়ের দিন হল, কোরবানির দিন (১০ জিলহজ) ও তার পরের তিন দিন (১১,১২ ও১৩ জিলহজ) পর্যন্ত কোরবানি করা যায়। পশু কোরবানি করার পর এর গোশত নিজে খাওয়া এবং দুস্থ-অভাবগ্রস্তদের খাওয়ানোর কথাও বলা হয়েছে।
আয়াতে এখানে كلوا শব্দটি আদেশসূচক হলেও এর অর্থ ওয়াজিব করা নয়; বরং অনুমতি দান ও বৈধতা প্রকাশ করা। দুৰ্দশাগ্ৰস্ত অভাবিকে আহার করানোর ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তার অর্থ এ নয় যে, সচ্ছল বা ধনী ব্যক্তিকে আহার করানো যাবে না। বরং বন্ধু, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন অভাবী না হলেও তাদেরকে কোরবানীর গোশত দেওয়া জয়েজ। এ বিষয়টি সাহাবায়ে কেরামের কার্যাবলী থেকে প্রমাণিত।
হজরত আলকামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু আমার হাতে কোরবানীর পশু পাঠান এবং নির্দেশ দেন, কোরবানীর দিন একে জবাই করবে, নিজে খাবে, মিসকীনদেরকে দেবে এবং আমার ভাইয়ের ঘরে পাঠাবে।’ (বায়হাকি ১০২৩৮)
হজরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাও একই কথা বলেছেন অর্থাৎ একটি অংশ খাও, একটি অংশ প্রতিবেশীদের দাও এবং একটি অংশ মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করো।’ (ইবনে কাসির)
২. وَ الۡبُدۡنَ جَعَلۡنٰهَا لَکُمۡ مِّنۡ شَعَآئِرِ اللّٰهِ لَکُمۡ فِیۡهَا خَیۡرٌ ٭ۖ فَاذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰهِ عَلَیۡهَا صَوَآفَّ ۚ فَاِذَا وَجَبَتۡ جُنُوۡبُهَا فَکُلُوۡا مِنۡهَا وَ اَطۡعِمُوا الۡقَانِعَ وَ الۡمُعۡتَرَّ ؕ کَذٰلِکَ سَخَّرۡنٰهَا لَکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ
‘আর কোরবানির উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি; তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ (জবাই) করো। যখন সেগুলো কাত হয়ে পড়ে যায়, তখন তা থেকে খাও। যে অভাবি, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবি চেয়ে বেড়ায়, তাদের খেতে দাও। এভাবেই আমি ওগুলিকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা হজ: আয়াত ৩৬)
আয়াতে বলা হয়েছে, কোরবানির পশু জবাইয়ের পর যখন দেহ থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে তা মাটিতে কাত হয়ে পড়ে যায় এবং প্রাণত্যাগ করে, তখন তার গোশত কাটতে শুরু করো। কারণ জীবন্ত পশুর গোশত কেটে খাওয়া নিষিদ্ধ। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘জীবিত অবস্থায় কোনো পশুর শরীর থেকে কেটে নেওয়া গোশত মৃতের ন্যায় (হারাম)।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)
ইসলামিক স্কলারদের মতে, কোরআনের এই আদেশের মান ওয়াজিব। অর্থাৎ কোরবানির গোশত খাওয়া কোরবানি দাতার জন্য জরুরি। তবে অধিকাংশ ওলামাগণের কাছে উক্ত আদেশের মান মোস্তাহাব বা জায়েজ। কোরবানিকৃত পশুর গোশত খাওয়া উত্তম। অতএব কেউ যদি সম্পূর্ণ গোশতকে বিলিয়ে দেয় এবং কিছু মাত্রও না খায়, তাহলে তাতেও কোনো দোষ নেই।
আর যারা ভিক্ষুক। এর অন্য একটি অর্থ অল্পে তুষ্ট ব্যক্তি। অর্থাৎ অভাবি কিন্তু ভিক্ষা করে না বা কারও কাছে কিছু চায় না। আবার যাঞ্চাকারী অভাবগ্রস্ত। কেউ কেউ করেছেন, বিনা যাঞ্চায় আগত ব্যক্তি। যাই হোক, এই আয়াত দ্বারা দলিল নিয়ে বলা হয় যে-
কোরবানির গোশতকে তিন ভাগ করা উচিত। একভাগ নিজে খাওয়ার জন্য। দ্বিতীয় ভাগ অতিথি ও আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়ার জন্য। আর তৃতীয় ভাগ ভিক্ষুক ও সমাজের অভাবগ্রস্তদের জন্য। এ কথার সমর্থনে এই হাদিসটি তুলে ধরা হয়। যাতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি তোমাদের তিন দিনের বেশি কোরবানির গোশত রাখতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি তোমরা খাও, প্রয়োজন মত জমা রাখো।’
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘খাও, সাদকা করো ও জমা রাখো।‘ আর একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘খাও, খাওয়াও ও সাদকা করো।’ (বুখারি)
উল্লেখিত আয়াত দুটি থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, কোরবানির পশুর গোশত নিজেরা খেতে পারবে, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা চায়; তাদেরকেও দেওয়া যাবে। আর যারা না চায় তাদেরকেও দেওয়া যাবে এবং যারা দুস্থ-অভাবগ্রস্ত তারাও খেতে পারবে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের উপদেশ ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কোরবানি করার এবং কোরবানির গোশত নিজে খাওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য পরিচিত আত্মীয়-স্বজন এবং অসহায়-গরিবদের মাঝে বিতরণ কারা তাওফিক দান করুন। আমিন।