১৮ মে ২০২৪, শনিবার, ১২:০০:৪৪ অপরাহ্ন


মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় হজের ভূমিকা
ধর্ম ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৬-২০২৩
মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় হজের ভূমিকা ছবি: সংগৃহীত


কালের চাকা ঘুরে আবারও আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে প্রভু প্রেমের স্মৃতি বিজড়িত অবিস্মরণীয় মাস ‘জিলহজ’। এই জিলহজ মাসেই বিশ্বের সমগ্র প্রান্তের উম্মাতে মুহাম্মদি একত্রিত হন পবিত্র মক্কায়। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা আদায় করে থাকেন মহা পবিত্র হজ। এ পবিত্র মাসেই আল্লাহ পাকের হাবিব রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছিলেন বিদায় হজে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।

পবিত্র কাবার চত্বর, পবিত্র মক্কা নগরীর পথঘাট, অলিগলি ও আজ আরাফাতের ময়দান এখন তালবিয়ার সুললিত ধ্বনিতে আলোড়িত মুখরিত-

لَبَّيْكَ اَللّهُمَّ لَبَّيْكَ - لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ - اِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ - لاَ شَرِيْكَ لَكَ

‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান-নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’

লাখ লাখ কণ্ঠের সম্মিলিত উচ্চারণে, অপূর্ব তালবিয়ার ভাবগাম্ভীর গুঞ্জরণে আরাফাতের চারদিক এখন ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত, বিপুলভাবে স্পন্দিত। চলছে অবিরাম পবিত্র বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, হচ্ছে অনবরত সাফা-মারওয়ার সায়ি। আত্মনিবেদন, আত্মসমর্পণ, মহান আল্লাহর ইচ্ছার সিন্ধুতে আপনাকে বিলীন করে দেয়ার সে এক অপূর্ব দৃশ্য, দিলকাশ মানযার!

প্রিয় পাঠক, দেখুন! হজের মধ্যে মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার সে কী অপূর্ব নজীর! চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত! কারও কোনো গর্ব নেই, অহংকার নেই, খালি মাথায় দুই টুকরো সেলাইবিহীন সাফেদ কাপড় পরে একই বেশে একই কালিমা উচ্চারণ করে একই কাবা ও ময়দানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে উম্মাতে মুহাম্মদির ঐসব আল্লাহভক্ত, পাগল পূন্যার্থীরা।

শুধু তাই নয়, আবারও দেখুন; গভীরভাবে লক্ষ করুন; ঐক্যের, একতার সে কী সুমধুর দৃশ্য! সাদাকালোর ভেদাভেদ নেই, আরবে-আজমে ব্যবধান নেই, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ফরাক নেই।

আহ! ঐক্যের সে কী অনবদ্য, অনুপম, হৃদয় জুড়ানো, মন মাতানো চিত্র!

বর্ণ, ভাষা, গোত্র, আঞ্চলিকতার সব দেয়াল এখানে টুটে গেছে, বৈষম্যের সমস্ত প্রাচীর এখানে ধ্বংস হয়ে গেছে। এক আল্লাহর বান্দা, এক আদমের সন্তান, একই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত, এক কোরআনের অনুসারী, একই চন্দ্র সূর্যের স্নিগ্ধ ও গনগনে  আলো উপভোগকারী, একই আসমানের নিচের ও জমিনের উপরের বাসিন্দারা আজ এ পবিত্র হজের বদৌলতে আল্লাহ পাকের হারাম ও আরাফাতের ময়দানে এসে একাকার হয়ে গেছে। মহামিলনের, মহা ঐক্যের, মহা সহমর্মিতার, মহা সৌভ্রাতৃত্বের সে এক অভাবনীয়, অকল্পনীয় অবস্থা! যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

হজের প্রকৃত আদর্শে আদর্শবান প্রিয় পাঠক! দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য যে, আজ আমরা বিশ্বের সর্বত্র জালিম কুফরি শক্তির হাতে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অপদস্থ, নিপীড়িত? কিন্তু এর কারণ কী? অথচ এমনটিতো কাম্য ছিল না। কারণ আমাদের রয়েছে ১৫০ কোটি সুদক্ষ জনশক্তির ৩০০ কোটি হাত, আমাদের আছে প্রায় ৬০/৬৫ টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আছে মুসলিম বিশ্বের পেট্রো-ডলার ছাড়াও অফুরন্ত খনিজ সম্পদ, সর্বোপরি আমাদের আছে চমৎকার ভৌগলিক অবস্থান। কিন্তু এত কিছুর পরও কেন আজ আমাদের এ করুণ দশা? কেন আজ আমরা সবার উপহাসের পাত্র? কেন নিন্দিত, নিগৃহীত?

আমার মতে এর মূল কারণ হলো- আজ আমাদের মধ্যে ঐক্য নেই, একতা নেই, গায়েব হয়ে গেছে সহানুভূতি, অদৃশ্য হয়ে গেছে মমত্ববোধ। কথাগুলো তিক্ত হলেও এটাই বাস্তব সত্য। অথচ হজের শিক্ষা ছিলো- ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে আকঁড়ে ধর এবং তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১০৩)

হজের মূল তাৎপর্যই তো ছিলো- ‘নিশ্চয়ই সমস্ত মুমিন ভাই ভাই।’ (সুরা হুজুরাত: আয়াত ১০)

হজের নসিহত তো ছিল- ‘সব মুসলমান এক দেহের ন্যায়’ এর অনুপম মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সকল খোদাদ্রোহী, কুফরি, তাগুতিবাদী ও বাতেল শক্তিসমূহের মোকাবেলায় সীসাঢালা প্রাচীর সৃষ্টি করা। কেননা বিদায় হজের ভাষণে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

‘হে ভ্রাতৃমন্ডলী! আমার বাণী মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করতে চেষ্টা কর। জেনে রেখো! সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সবাই একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। সমগ্র দুনিয়ার সকল মুসলমান একই অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ।

স্মরণ রেখো! বাসভূমি ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মুসলমান সমান। আজ থেকে বংশগত কৌলিন্য প্রথা বিলুপ্ত হলো। পরস্পরের প্রাধান্যের একমাত্র মাপকাঠি হল খোদাভীতি বা সৎকর্ম। সে ব্যক্তিই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন, যে নিজ কার্য দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। আমি তোমাদের কাছে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অন্যটি হলো আমার সুন্নাহ।

উল্লেখিত হজের প্রকৃত উদ্দেশ্য তো ছিলো- জাতি, গোত্র, বংশ, বর্ণ মর্যাদা পায়ে দলে, এক আল্লাহর বান্দা ও এক রাসুলের উম্মাত হিসাবে ইসলামি ঐক্যের ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রাখা।

সুতরাং আসুন, আমরা হজের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষা লাভ করে, মূল চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে, সমস্ত বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলি, একটি সুন্দর ভ্রাতৃতুল্য সমাজ গড়ি, একই পতাকাতলে একত্রিত হওয়ার শপথ গ্রহণ করি। তবেই হবে আমার এ আলোচনা স্বার্থক ও সফল।

আবু তালহা তোফায়েল, লেখক: তরুণ আলেম, সাংবাদিক ও সংগঠক।