২৮ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৩:০২ পূর্বাহ্ন


নান্দনিক রূপ পাবে ॥ কল্যাণপুর হাইড্রো ইকোপার্ক
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৬-২০২৩
নান্দনিক রূপ পাবে ॥ কল্যাণপুর হাইড্রো ইকোপার্ক ফাইল ফটো


হাতিরঝিলের চেয়েও নান্দনিক ও অনন্য সৌন্দর্যের ছোঁয়া থাকবে কল্যাণপুর হাইড্রো-ইকোপার্কে। যা শুধু নগরবাসী নয়- গোটা দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রের মর্যাদা পাবে। একদিকে চলাচলের সুবিধা অন্যদিকে বিনোদনের উপাদান সবই থাকছে পার্কে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজের শুভ উদ্বোধন ও সমাপনের তোড়জোড় চলছে। এটি নির্মাণ করা হলে নগরবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি ওই এলাকার যানজটের অভিশাপমুক্ত হয়ে স্বস্তি ফিরে পাবে। মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেনÑ এটি রাজধানীর অন্যতম সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। বিনোদন ও যোগাযোগের সমন্বয় থাকবে এখানে। এখন চলছে ড্রয়িং ডিজাইনের কাজ। পুরো কাজ শেষ হলে এসব এলাকায় আর জলাবদ্ধতা থাকবে না। নগরবাসীর কাছে কল্যাণপুরের পরিচয় মানেই হচ্ছেÑ অবৈধ দখলদারি, বস্তি, নোংরা জলাধার ও মাদকের নিরাপদ আস্তানা। বিশেষ বর্ষায় মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কল্যাণপুর, শেওড়াপাড়ায় কাজীপাড়ায় জলাবদ্ধতা নিত্যকার চিত্র। মানুষজন পড়ে সীমাহীন ভোগান্তিতে। এখানকার পানি গিয়ে জমা হয় কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ডে বা জলাধারে। এমন জঞ্জালময় পরিস্থিতির অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়ে এলাকার চেহারা বদলে দিতে মেয়র আতিকুল ইসলাম স্বপ্ন দেখেছেন অনন্য সৌন্দর্যের ছোঁয়া লাগাতে। তিনি সেভাবেই এগিয়ে যান। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বড় ধাপ ড্রয়িং ডিজাইন চূড়ান্ত করা হচ্ছে তারই সার্বিক দিক নির্দেশনায়। বহুমুখী বাধা বিঘœ পেরিয়ে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই প্রকল্পটিকে। বাধাকে গাদা বানিয়ে তিনি শেষ করেছেন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ।


জানতে চাইলে মেয়র আতিকুল বলেন, এখানে কি ছিল আর কি হতে যাচ্ছে সেটা নগরবাসীই দেখতে পাবেন। আসলে এখানে জলাধার ঘিরে একটি বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে এটি কেউ আগে চিন্তাও করতে পারেনি। এখন পার্ক তৈরির জন্য রিটেনশন পন্ডে খনন কাজ চলছে। এটা করতে গিয়ে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কিন্তু কোনো বাধাই আমাদের কাজ বন্ধ করতে পারবে না। এই ইকোপার্ক সব বয়সের মানুষের জন্য করা হবে। শিশু, নারী, পুরুষ ও বয়স্কদের সব সুবিধা সেখানে থাকবে। আমরা জলাশয়টি ঘিরে সিটি রেস্ট গড়ে তুলব।


নগর বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত রিটেনশন (জলাধার) পুকুরগুলো বৃষ্টিপাতকে ধরে রাখতে এবং বিতরণ করতে ব্যবহৃত হয়, যা ফলস্বরূপ বন্যা প্রতিরোধে সহায়তা করে। ব্যাংক স্থিতিশীলতা প্রদানের জন্য তারা প্রায়ই বিভিন্ন ঘাস, ঝোপঝাড়; অথবা জলাভূমি গাছপালা দিয়ে ল্যান্ডস্কেপ করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কল্যাণপুরে রিটেনশন এলাকা ব্যবহার করে একটি ইকোপার্ক নির্মাণের একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই উদ্যোগটি রিটেনশন এলাকাগুলোকে রক্ষা করবে। পুরো এলাকাটিকে হাতিরঝিলের মতো একটি বিনোদন এলাকায় রূপান্তরিত করবে।


উত্তর সিটির তথ্যানুসারে, এখানে জল ধরে রাখার জায়গাটি মোট ১৭৮.৮২ একর এলাকা জুড়ে রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নযয়ন করপোরেশন ৯৮.৩৫ একর, বাংলাদেশ পানি উন্নযন বোর্ড ৬.৩৬ একর এবং সরকার ১১.৪০ একর মালিকানাধীন। ডিএনসিসি এখন ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব জমির ৯,৭১ একর এবং অধিগ্রহণকৃত ৫৩,০০০ একর জমি নিয়ন্ত্রণ করছে। জলাশয়ের  চারপাশে অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে।


সর্বশেষ গত সপ্তাহে গিয়ে কল্যাণপুর গিয়ে দেখা গেছে- এই জলাধার থেকে ৩০ লাখ ঘনফুট মাটি ও ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের ১০টি জোনের মধ্যে পাঁচটি প্রকৃতি ভিত্তিক হবে, যার মধ্যে একটি যুব বেস ক্যাম্প, মৌমাছির উপনিবেশসহ একটি জীববৈচিত্র্য দ্বীপ, একটি প্রজাপতি বাগান, একটি পাখির এভিয়ারি এবং একটি জলজ পার্ক রয়েছে। সমগ্র অঞ্চল জলপথ দ্বারা সংযুক্ত করা হবে। দর্শনার্থীদের জন্য কোনো প্রবেশ মূল্য থাকবে না। মানুষ ১২-১৪ পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। জোনগুলোতে ফুটপাত, সাইকেল লেন, শিশুদের খেলার মাঠ, বর্জ্য নিষ্কাশন এবং ব্যবস্থাপনা এবং উচ্ছেদকৃত বাসিন্দাদের জন্য একটি পুনর্বাসন সুবিধাসহ ৫০টিরও বেশি পরিষেবা থাকবে। জোন-৭-এ ৯০০-বর্গফুটের ফ্ল্যাট থাকবে এবং জোন-৮-এ থাকবে কৃষিজমি, কোল্ড স্টোরেজ এবং একটি বীজ গুদাম। জোন-৯-এ একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বহুমুখী হল এবং প্রদর্শনী স্থান থাকবে; জোন-১০-এ একটি সৌর-জল শোধনাগার এবং একটি পার্ক থাকবে। নৌকা সব জোনের মধ্যে পর্যটকদের নিয়ে যাবে।


সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখানে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সমান্তরালে চলছে মাটি খনন ও নকশা তৈরির কাজ। কল্যাণপুর জলাধারের আয়তন ৫৩ একর। কয়েক যুগ ধরে এ জায়গা অবৈধভাবে দখল করে বসতি গড়ে তুলেছিল একটি চক্র। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন সে জায়গায় চলছে হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণের তোড়জোড়। যদিও অনেকেই এখনো নানাভাবে জটিলতা তৈরির মতো হীন প্রচেষ্টায় তৎপর। একটি চক্র ক্ষতিপূরণের অজুহাতে নানা ধরনের ইস্যু সামনে আনার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে যারা এখানে বসতি গড়ে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্য করছিল- তারাই এখন মেয়রের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে- এটা তাদেও পৈতৃক সম্পত্তি। কেউ কেউ আবার ক্রয়সূত্রে মালিকানাও দাবি করছে। তাদের কথা হচেছ- সিটি করপোরেশন তাদের অবৈধভাবে উচ্ছেদ করেছে। কাজেই জমি অধিগ্রহণের জন্য দিতে হবে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ।


ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, গোটা এলাকাটাই ছিল সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ ও মাদকের নিরাপদ আস্তানা। বর্ষাকালেও এখানে নৌকায় করে চলত মাদকের কেনাবেচা। বর্ষা ছাড়াও সারাবছর মোহাম্মদপুর, আদাবর, শ্যামলী, কল্যাণপুর, মিরপুর, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার বৃষ্টির পানি এসে এখানে জমা হয়। পরে জলাধার থেকে পানি পাম্পের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়। দুই বছর আগে এ জলাধারের মালিকানা ডিএনসিসিকে সোপর্দ করে ঢাকা ওয়াসা। তারপরই বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম পরিকল্পনা করে এখানকার চেহারা বদলে দিতে। বিশেষ করে এ এলাকার সৌন্দর্য বাড়াতে জলাধার ঘিরে হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই লক্ষ্যেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে নকশা প্রণয়নের কাজ করছে সংস্থাটি। আগামী দুই বছরের মধ্যে ইকোপার্ক নির্মাণ কাজ শেষ করতে চায় সিটি করপোরেশান।


এ বিষয়ে সরজমিনের দেখা যায়, বিশাল এলাকা জুড়েই এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এখানে কি হচ্ছে সেটাই এখন মানুষের কৌতূহলী প্রশ্ন। জলাশয় ও আশপাশের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থাপনার ভাঙা অংশ পড়ে রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। জলাধার অংশ ময়লা-আবর্জনায় ভরা। আলাদা তিনটি ভেকু দিয়ে তা পরিষ্কার করা হচ্ছে। এভাবে পুরো জলাধার খনন করতে কতদিন সময় লাগতে পারে বা কি পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা এবং মাটি সেখান থেকে অপসারণ করা হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি তারা। তবে গত ১৩ মে পর্যন্ত এই জলাধার থেকে ৩০ লাখ ঘনফুট মাটি ও বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। মেয়রের নির্র্দেশনা রয়েছে- পুরো জলাশয় অংশ থেকে মাটি ও বর্জ্য অপসারণের। এখন সেখানে অপসারণ করা হচ্ছে- অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা। যদিও কবে নাগাদ কাজটা শেষ করা সম্ভব হবে সেটা কেউ বলতে পারেননি।


শ্যামলী এলাকার বাসিন্দা মাহিমুল হোসেন মিয়া বলেন- এলাকাটা আগে কি ছিল, এখন কি হচ্ছে- আর ভবিষ্যতে কি হতে যাচ্ছে সেটা ভাবতেই অবাক লাগে। কেননা এই জলাশয় দীর্ঘদিন বেদখলে ছিল নানা বাহিনীর অধীনে। যুগ যুগ ধরেই অবৈধ দখলে ছিল গোটা এলাকা। প্রভাবশালী এসব দখলবাজাদের উচ্ছেদে সরকারের কোনো পদক্ষেপ ছিল না। কিন্তু বর্তমান মেয়র আতিকুল সাহেব যেভাবে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। সেজন্য এলাকাবাসীও বেশ আনন্দিত ও তার প্রতি কৃতজ্ঞ। এখানে যদি হাতিরঝিলের মতো একটা সুন্দর কিছু করা হয়- তাহলে এ্ই এলাকার চেহারাই বদলে যাবে।


এদিকে অত্যাধুনিক এই প্রকল্প সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- রাজধানীর অভিশপ্ত জলাবদ্ধতা নিরসন ও সৌন্দর্য বাড়াতে ২০২০ সালে ১৩টি খাল ও জলাশয় সোপর্দ করা হয় ঢাকা উত্তর সিটিকে। এতদিন এলাকাটা ছিল ওয়াসার দখলে। তাদের কাছ থেকেই দখল বুঝে নেয় সিটি করপোরেশন। তারপরই শুরু হয় মূল কাজ। এসব খাল থেকে প্রাথমিকভাবে ময়লা-আবর্জনা, অবৈধ স্থাপনা অপসারণের কাজ চলে। তারপর গত জানুয়ারিতে গোটা এলাকা বিশেষ করে কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ড দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেন মেয়র। আর এ সুযোগে অবৈধ দলখদাররা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তারা জমির মালিকানা দাবি করেন। প্রতিবাদ ও মানববন্ধন গড়ে তুলেন। এখনো নানা ধরনের দাবিতে সোচ্চার। তবে এদের বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এটা আগে থেকেই অধিগ্রহণ করা ছিল। ঢাকা ওয়াসা জলাশয়ের এই জমি অধিগ্রহণ করে ১৯৮৯ সালে। তখন ডিসি অফিস থেকে জমির মালিকদের টাকা দেওয়া হয়েছে। যারা টাকা নিয়েছেন তারাই আবার এখানের জায়গা দখল করে রেখেছিলেন। তার যখন এখন দেখছে- কিছু একটা হতে যাচ্ছে তাই সংঘবদ্ধ হয়েই মাঠে নেমেছে। কাজেই এদের আর ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।


এ বিষয়ে মেয়র আতিকুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঢাকা শহরে হাতিরঝিল প্রকল্প করে দিয়েছেন। কল্যাণপুরে আমরা তেমনি প্রকৃতিনির্ভর ইকোপার্ক নির্মাণ করব। এখানকার রিটেনশন পন্ডে পাঁচটি খাল থেকে বৃষ্টির পানি যায়। যত বৃষ্টি পড়বে এই রিটেনশন পন্ডে পানি যাবে। এরপরে পাম্প করে নিয়ে যাবো তুরাগ নদে। এলাকাগুলোতে কোনো জলাবদ্ধতা হবে না। এটা নির্মাণের পর শুধু এ এলাকা নয় গোটা ঢাকাবাসীই তার সুফল পাবেন। একদিকে সৌন্দর্য অন্যদিকে বিনোদনকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সত্যিই স্বপ্নময় হয়ে উঠবে এই ইকো পার্ক।