মেধাবী হলেও দরিদ্রতা আর জীবিকার টানাপোড়েনে পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। তবে প্রেম তাদের এগিয়ে ছিল বহুদূর। সেই প্রেমই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াল দুজনের জীবনে। প্রেমিকের হাতে টুকরো টুকরো হয়ে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন তানজিনা। আর প্রেমিকাকে হত্যার পর ১০ মাসে ২০টি মোবাইল সেট ও ২৫টি সিম ব্যবহার করেও শেষ রক্ষা হয়নি প্রেমিক রাসেল মিয়ার।
বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) পুলিশের জালে ধরা পড়ার পর আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঘাতক রাসেল মিয়া হত্যাকাণ্ডের যে নৃশংস বর্ণনা দিয়েছেন তা শুনে হতভম্ব হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আদালতে উপস্থিত সবাই।
২০২১ সালের ৫ এপ্রিল ফতুল্লার মাসদাইর বাড়ৈভোগ এলাকার একটি ডোবা থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ের দেহবিহীন একটি মাথা উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ঘটনার প্রায় ১০ মাস পর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন রংপুরের মিঠাপুকুর থানার এনায়েতপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে রাসেল মিয়া। ২০১০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় একই বিভাগ থেকে ৩.৭০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন ওই এলাকারই আব্দুল জলিলের মেয়ে তানজিনা আক্তার। একই এলাকার হওয়ায় তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু জীবিকার তাগিদে পরবর্তীতে ঢাকার সাভারে চলে আসেন তানজিনা, আর নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন রাসেল মিয়া।
তানজিনার পরিবার তাদের প্রেমের সম্পর্ক জানতে পারলেও মেনে নেয়নি। কারণ, রাসেল ছিল খর্বাকৃতির ও কালো। পরিবার না মানলেও রাসেল ও তানজিনার যোগাযোগ ছিল। ২০১৯ সালে মোনালিসা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রাসেল। তার বিয়ের সংবাদ শুনে তানজিনা বাড়ি থেকে বের হয়ে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন এবং গার্মেন্টেসে চাকরি নেন। পরে তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পশ্চিম দেওভোগ আদর্শ নগরে একটি ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাট বাসায় বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে তানজিনাকে সন্দেহ হয় প্রেমিক রাসেলের। এ নিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় কলহ।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, জবানবন্দিতে আসামি রাসেল জানিয়েছেন, তার (রাসেল) সঙ্গে বসবাস করলেও তানজিনা মৃত বোনের স্বামী মোস্তফাসহ বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। এ নিয়ে তানজিনার সঙ্গে তার মূল বিরোধ শুরু হয়। ঘটনার দিন ২০২১ সালের ২৯ মার্চ শবে বরাতের রাত ৩টায় কলহের জের ধরে রাসেল ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরে থাকা বটি দিয়ে তানজিনাকে হত্যা করেন। পরে হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে রেখে দেন। পরে বিভিন্ন সময়ে খন্ডিত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ তার বাসার ছাদ থেকে পার্শ্ববর্তী ময়লার স্তপের মধ্যে ফেলে দেন। তখন রাসেল তার বাড়িওয়ালা সিরাজ খানকে জানান- তার স্ত্রী তানজিনা করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছেন। এ ঘটনার পর রাসেল তার ভাড়া বাসা ছেড়ে হাঁড়ি-পাতিল ও হত্যার কাজে ব্যবহৃত বটি নিয়ে গোপনে পালিয়ে যান।
নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম জানান, রাসেল গ্রেপ্তারের পর নিহত তানজিনাকে স্ত্রী বলে দাবি করলেও সে কোনো কাবিননামা বা দলিল দেখাতে পারেনি। আসামি রাসেল এই ১০ মাসে বিভিন্ন সময়ে নামে বেনামে ২০টি মোবাইল ও ২৫টি সিম ব্যবহার করেন। অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকে। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুর থানার এনায়েতপুর থেকে রাসেলকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পিবিআই।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) শাকিল হোসেন বলেন, আসামি রাসেলের দেওয়া তথ্য মতে বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ফতুল্লার আদর্শনগর এলাকার একটি ডোবা থেকে ওই নারীর হাড়গোড়ের ১৯টি অংশ বিশেষ উদ্ধার করেছি। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বটি ও মরদেহের টুকরো রাখা সেই ফ্রিজ জব্দ করেছি।
তিনি জানান, আসামি রাসেল আজ বিকেলেই নারায়ণগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নূর মহসিনের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালত আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
রাজশাহীর সময় /এএইচ