বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও ভবন মালিকরা সতর্ক হচ্ছেন না। এ অবস্থায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা মার্কেটগুলোয় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে চায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির বিদ্যমান আইনে এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের (ঢাকা) উপপরিচালক দিনমনি শর্মা যুগান্তরকে বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ বা অতিঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে মার্কেট বন্ধ করে দেওয়ার এখতিয়ার ফায়ার সার্ভিসের নেই। মার্কেট বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য আইন সংশোধনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি জানান, ‘হাতেগোনা দু-একটি বিশেষায়িত শপিংমল ছাড়া অবশিষ্ট কোনো মার্কেটে আগুন নেভানোর জন্য পরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থাই নেই। চোখের সামনে এত ক্ষয়ক্ষতি দেখার পরও মার্কেট কর্তৃপক্ষ সচেতন না হলে আগুন একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কেননা কোনো কোনো মার্কেট এতটা ঘিঞ্জি, যেখানে ফায়ার ফাইটাররা যেতেই পারেন না। এজন্য মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করলে হয়তো সচেতনতা আসবে।’
সম্প্রতি রাজধানীতে বড় ধরনের দুটি অগ্নিকাণ্ডের পর ৫৮টি মার্কেট জরিপ করে ফায়ার সার্ভিস ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। এতে নিয়ম না মানার ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে আলোচিত চারটি মার্কেটের ত্রুটিগুলো যুগান্তরের কাছে এসেছে। মার্কেটগুলো হলো নিউমার্কেট সংলগ্ন গাউছিয়া মার্কেট, রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, মৌচাক মার্কেট এবং গুলিস্তানের পাতাল সড়ক মার্কেট। এসব মার্কেটের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থায় ভয়াবহ ত্রুটির ফিরিস্তি তুলে ধরেছে ফায়ার সার্ভিস।
গাউছিয়া মার্কেট সম্পর্কে সংস্থাটির জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, এখানে পরিকল্পিত ফায়ার প্রোটেকশন প্ল্যান নেই। মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ। পাম্পহাউজ (ফায়ার পাম্প, জকি পাম্প, ডিজেল পাম্প) হাইড্রেন্ট নেই। জেনারেটর রাখা হয়েছে ষষ্ঠ তলায়। ডিটেকশন ব্যবস্থা, কল পয়েন্ট, ফায়ার অ্যালার্ম, কন্ট্রোল প্যানেল, এক্সিট সাইন, ইমার্জেন্সি লাইট প্রভৃতি নেই। সিঁড়িকোঠায় দোকান বসানো হয়েছে। করিডরে এলোমেলো এবং ঝুলন্ত কেবল সর্বত্র। ছাদের দরজা সর্বদা বন্ধ রাখা হয়।
টিকাটুলিতে অবস্থিত রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই মার্কেটেও পরিকল্পিত ফায়ার প্রোটেকশন প্ল্যান নেই। চতুর্থ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় সাবস্টেশন বিদ্যমান। পাশেই আবাসিক ভবন। মার্কেটের করিডর বিভিন্ন দোকানের মালামাল দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। করিডর ও দোকানের সিলিংগুলোয় ঝুলন্ত কেবল বিদ্যমান। ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নেই। দোকানের সামনে ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক মিটার স্থাপন করা হয়েছে। ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নেই। ইলেকট্রিক ওভেন, ইলেকট্রিক ডিভাইসগুলো সব সময় চার্জারের সঙ্গে লাগানো থাকে।
মালিবাগের মৌচাক মার্কেট সম্পর্কে বলা হয়, এখানেও পরিকল্পিত ফায়ার প্রোটেকটশন প্ল্যান নেই। পাম্প হাউজসহ হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা নেই। ডিটেকশন ব্যবস্থা, কল পয়েন্ট, ফায়ার অ্যালার্ম, কন্ট্রোল প্যানেল, এক্সিট সাইন, ইমার্জেন্সি লাইট প্রভৃতি কিছুই নেই। করিডরে দোকান বসানো হয়েছে। কেবল ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। সাবস্টেশন রুমে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নেই। ওয়াটার রিজার্ভার কাজের উপযোগী নয়।
গুলিস্তানের পাতাল সড়ক মার্কেট আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভারই নেই। নেই পরিকল্পিত ফায়ার প্রোটেকশন প্ল্যানও। একটি মার্কেটের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাটিও নেই। এখানেও পাম্প হাউজসহ হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা নেই। বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ব্যবস্থা খোলা, ওয়্যারিংগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। ডিটেকশন ব্যবস্থা, কল পয়েন্ট, ফায়ার অ্যালার্ম, কন্ট্রোল প্যানেল, এক্সিট সাইন, ইমার্জেন্সি লাইট প্রভৃতি কিছুই নেই। ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি এই মার্কেটে একবার আগুন লেগেছিল।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ১৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে মার্কেটের অভ্যন্তরে কেউ যাতে ধূমপান না করে সে বিষয়ে তীক্ষè নজরদারি করা। মার্কেটের অভ্যন্তরে রান্নার কাজে কোনো ধরনের চুলা বা হিটার ব্যবহার করা যাবে না। মার্কেটের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ না থাকলে খোলা বাতি ব্যবহার করা যাবে না। মানসম্পন্ন বৈদ্যুতিক ফিটিংস ও তার ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যুতের লুজ ফিটিংস, ওয়্যারিংগুলো দ্রুত অপসারণ নিশ্চিত করা। বৈদ্যুতিক সুইচ বা স্থাপনার সন্নিকটে কোনো দাহ্যবস্তু না রাখা। মার্কেট বন্ধকালীন সব বিদ্যুৎ লাইন আবশ্যকীয়ভাবে বন্ধ রাখতে হবে। কেবল সীমিতভাবে সম্পূর্ণ পৃথক মানসম্পন্ন লাইনে নিরাপত্তা বাতির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মার্কেট বন্ধকালীন এর অভ্যন্তরে চলাচলের পথে বসার চেয়ার, টুল, বেঞ্চ, সেলাই মেশিন প্রভৃতি রাখা যাবে না। রাত্রিকালীন মার্কেটের পাহারায় নিয়োজিত নিরাপত্তারক্ষীদের সংখ্যা ও তৎপরতা/নজরদারি বৃদ্ধি করা। মার্কেটের গেটগুলো ভেতর দিক থেকে তালা দেওয়া যাবে না। রাত্রিকালীন মার্কেটের গেটগুলো বাইরের দিক থেকে তালা লাগাতে হবে। রাত্রিকালীন মার্কেটের অভ্যন্তরে নিরাপত্তারক্ষী কর্তৃক নিয়মিত চলাফেরা ও নজরদারির জন্য বিভিন্ন দিকের কয়েকটি গেট খোলা রাখা। মার্কেটের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে প্রচুরসংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র মজুত করা প্রয়োজন এবং দোকান মালিকসহ নিরাপত্তারক্ষীদের সেগুলো ব্যবহারে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস থেকেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মার্কেটে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যরত যে কেউ ফায়ার সার্ভিসের মেইন গেটের সেন্ট্রিকে অথবা কন্ট্রোলরুমে সংবাদ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
মার্কেটের যে কোনো স্থানে রাত্রিকালীন কাউকে ঘুমানো অথবা অবস্থানের সুযোগ না দেওয়া। দ্রুত লোক অপসারণ ও অগ্নিনির্বাপণে ওপর তলায় উঠার সিঁড়িতে মার্কিং দেওয়া প্রয়োজন। মার্কেটের ওপরের তলার জেনারেটরগুলোকে নিচে নিরাপদ স্থানে স্থাপন করা। পরিকল্পিত ফায়ার প্রোটেকশন প্ল্যান প্রণয়নপূর্বক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন লাগার দুই সপ্তাহের মধ্যে শনিবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে নিউমার্কেটসংলগ্ন ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ৩ ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ভয়াবহ এ আগুন নিয়ন্ত্রণে একপর্যায়ে মাঠে নামেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর চৌকশ সদস্যরা। ২৭ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মার্কেট কিংবা গোডাউনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে।