২৮ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৮:১৯ পূর্বাহ্ন


ক্যাসিনো জুয়া বন্ধে আসছে জামিন অযোগ্য আইন
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৪-২০২৩
ক্যাসিনো জুয়া বন্ধে আসছে জামিন অযোগ্য আইন ফাইল ফটো


রাজধানীতে ক্যাসিনো ব্যবসা ভয়ানক আকার ধারণ করার খবরটি প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৯ সালে। শুরু হয় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান।

এর আগে মানুষ জানত বিভিন্ন ক্লাবে বা পাড়া-মহল্লায় জুয়া খেলা হয়। কিন্তু জুয়ার আদলে অফলাইন এবং অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে ক্যাসিনো ব্যবসা করে অনেকেই রাতরাতি ফুলেফেঁপে ওঠেন।



বিপরীতে কেউ হন পথের ফকির। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক প্রভাবশালীর নাম বেরিয়ে আসে। একে একে গ্রেফতার হন তাদের অনেকেই। কিন্তু জুয়া বা ক্যাসিনো খেলার অপরাধে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয় অন্য কোনো অপরাধে। কেউ গ্রেফতার হন মাদকের মামলায়। কেউ অস্ত্র মামলায়। কেউ মানি লন্ডারিং মামলায়। পরে তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান, তদন্ত বা মামলা হয়। কিন্তু ক্যাসিনোয় খেলার অপরাধে তাদের কারও বিরুদ্ধে মামলা বা সাজা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

এরপরই প্রশাসনের পক্ষ থেকে জুয়াসংক্রান্ত ১৫৬ বছরের পুরোনো অচল আইনটি নতুন করে প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসাবে ১৮৬৭ সালের ‘বঙ্গীয় জুয়া আইন’ বাতিল করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন আইনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘জুয়া আইন ২০২৩’। এ আইনে ক্যাসিনো খেলায় জড়িত জুয়াড়ির সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (আইন ও শৃঙ্খলা) অনুবিভাগের যুগ্মসচিব মো. আব্দুল মতিন যুগান্তরকে বলেন, ক্যাসিনো অপরাধীরা এ আইনের আওতায় আসবে। তবে আইনটি শুধু খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কি হয় তা চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ১৮৬৭ সালের বঙ্গীয় জুয়া আইনে জুয়াড়িদের শাস্তির পরিমাণ খুবই কম। যাদের জুয়া খেলার অপরাধে আটক করা হয়, শাস্তি কম হওয়ায় অপরাধীরা দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে আবার একই অপরাধে জড়ান। জুয়ার টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেকে ছোটখাটো চুরি, ছিনতাই, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মতো বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় ছিনতাই করতে গিয়ে অনেকে মারা যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত জুয়া আইনে প্রকাশ্যে জুয়া তথা ক্যাসিনোর আসর বসালে ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

সূত্র জানায়, আইনটি সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসকরাই একাধিকবার প্রস্তাব করেন। বঙ্গীয় জুয়া আইন সংশোধন করে শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধিরও প্রস্তাব করেন। তাদের দেওয়া প্রস্তাবের আলোকে আইনটি বাতিল করে নতুন আইন প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। আইনের খসড়া তৈরি করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত নেওয়া হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আইনের খসড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মতামতের জন্য তাদের কাছে পাঠিয়েছে। দেখেশুনে মতামত দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

খসড়ায় বলা হয়েছে, জুয়ার আখড়ায় আটক সব অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হবে। আইনের খসড়ায় জুয়ার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসকের (ডিসি) পূর্বানুমতি ছাড়া সব ধরনের বাজি ধরা, অর্থ কিংবা পণ্যের বিনিময়ে প্রতিযোগিতামূলক সব ধরনের হাউজি, সব ধরনের লটারি, অর্থ বা পণ্যের বিনিময়ে ভাগ্য নির্ধারণে ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় অংশ নেওয়াই জুয়া। আইনের খসড়ায় বাজির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে বিদ্যমান সব ধরনের খেলা বা কোনো বিষয়ের ফলাফল সম্পর্কে আগে থেকে কোনো অভিমত জ্ঞাপন করে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কিংবা প্রযুক্তির মাধ্যমে অর্থ, পণ্য, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ওপর বাজি ধরা বা বাজি হিসাবে গণ্য হবে।

আইনের খসড়ায় আরও বলা হয়, যিনি নিজে অথবা কর্মচারী কিংবা এজেন্টের মাধ্যমে নগদ অর্থ বা আর্থিক মূল্যমানের কোনো পণ্য বা সম্পত্তির বিষয়ে বাজি বা জুয়ার আয়োজন করেন, জুয়ার মধ্যস্থতা করেন, নিজেকে বাজি বা জুয়ার আয়োজনকারী বা মধ্যস্থতাকারী হিসাবে প্রচার করবেন বা করান তিনি বাজিকর হিসাবে চিহ্নিত হবেন। তবে সরকার চাইলে কোনো পর্যটন এলাকাকে বিশেষায়িত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে ওই এলাকার হোটেল বা ক্লাবকে সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে জুয়া খেলার ক্যাসিনো উন্মুক্ত করে দিতে পারবে। যেমন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতসহ বিভিন্ন এলাকা। যেখানে হাজার হাজার বিদেশি পর্যটক আগমন করেন। তাদের জন্য এ ধরনের আইনি বাধা থাকা ঠিক হবে না।

আইনের খসড়ায় আরও বলা হয়, যার কাছে বাজিকর ব্যবসায় ব্যবহৃত বই, হিসাবপত্র, দলিল, কার্ড, সার্কুলার, ইলেকট্রনিক রেকর্ড অন্য কোনো বস্তু উদ্ধার হবে সে বাজিকর হিসাবে চিহ্নত হবে। অনলাইন বেটিংয়ের সংজ্ঞায় আইনের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়, অনলাইন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিজিটাল মাধ্যমে খেলাধুলা, বাজি ধরার জন্য নগদ ক্যাশ, ক্যাশবিহীন ব্যাংকিং লেনদেন ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন অর্থাৎ বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, পেপাল ইত্যাদি বা বিট কয়েনসহ অন্য যে কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি বোঝাবে। মালিক বা পরিচালনাকারী হয়ে কোনো গৃহ সাইবার ক্যাফে অনুরূপ অন্য কোনো স্থানকে অনলাইন বেটিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে দেন তাহলে তিনি এ আইনের অধীনে বেটিং বলে গণ্য হবে।

খসড়া জুয়া আইনে পাতানো খেলা বলতে পূর্বে থেকে প্রতিযোগিতামূলক খেলা বা খেলার অংশ বিশেষের ফলাফল নির্ধারণ করাকে বোঝাবে। জুয়ার সামগ্রী বলতে জুয়া বা বাজির কাজে ব্যবহৃত অর্থ, খাতা, ইলকট্রনিক রেকর্ডকে বোঝানো হবে। জুয়ার স্থান বলতে উপার্জনের জন্য জুয়া খেলার ঘর, কক্ষ, তাঁবু, প্রাচীর বেষ্টিত স্থান, প্রকাশ্য স্থান, সড়ক, নৌ এবং আকাশযানসহ সব ধরনের যানবাহনকে বোঝাবে।

আইনের খসড়ায় আরও বলা হয়, অতিরাষ্ট্রিক এখতিয়ার রাখা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিদেশে বসে এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করলে তা দেশের ভেতরেই করেছেন ধরা হবে। ডিসি বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা ডিসি মনোনীত অফিসার বা জেলা পলিশ সুপার নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংবাদ পেয়ে অনুমতি নিয়ে পরিদর্শক পদমর্যাদার কোনো অফিসার যে কাউকে আটক করতে পারবেন। উদ্ধার করতে পারবেন জুয়ার কাজে ব্যবহৃত সব সরঞ্জাম অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী।

আইনের খসড়ায় বলা হয়, প্রকাশে কেউ জুয়া খেললে ৩ বছরের কারাদণ্ড অথবা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ঘরে-বাহিরে, মাঠে, তাঁবুতে, প্রাচীর বেষ্টিত কোনো স্থানে যানবাহনে, নৌযানে, কিংবা আকাশযানে ম্যানুয়ালি অথবা ডিজিটালি যে ভাবেই জুয়া খেলা হোক না কেন তা অপরাধ এবং তজ্জন্য উপরিউক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে। কোনো ব্যক্তি জুয়া খেলার স্থানে উপস্থিত থাকলে তার দুই বছরের কারাদণ্ড অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বাজিকর হিসাবে কাজ করলে এই আইনের অধীনে দুই বছরের কারাদণ্ড অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। জুয়ার আসর থেকে আটক ব্যক্তি যদি নিজের নাম-ঠিকানার ভুল তথ্য দেন তাহলে তার ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া অর্থদণ্ডের টাকা পরিশোধ না করলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে সর্বোচ্চ ৩ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করবেন। কোনো খেলা পাতানো করার জন্য খেলোয়াড়, আয়োজনকারীসহ যারা এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন তারা সবাই দোষী সাব্যস্ত হবেন। তাদের প্রত্যেকের ২ বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অনলাইন বেটিংয়ে অপরাধ সংঘটন করলে তার ৩ বছরের কারাদণ্ড, তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।