ইতেকাফের প্রস্তুতি নিয়ে ২০ রমজান ইফতারের আগেই মসজিদে হাজির হবেন রোজাদার মুমিন মুসলমান। কিন্তু রোজাদার কেন ইতেকাফে বসবেন? ইতেকাফের মাসায়িল বা তথ্যগুলো কী?
রমজানের শেষ দশ দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ইতেকাফ। এ দশকে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তি এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য ইতেকাফ জরুরি বিষয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম আমৃত্যু ইতেকাফ করতেন।
ইতেকাফের পরিচয়: ইতিকাফ মানে হলো আঁকড়ে ধরা অর্থাৎ উদ্দেশ্য হাসিলের নিমিত্তে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা ও তার প্রতি মনকে আবদ্ধ রাখা। ইসলামি শরিয়তে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য মসজিদে অবস্থান করাই ইতেকাফ।
ইতিকাফে বসার কারণ: মুসলিম উম্মাহ রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য ইতেকাফে বসেন। কারণ, আগের সব নবি-রাসুলগণ ও তাদের উম্মতগণ শ’বছর/হাজার বছর হায়াত (জীবন) পেয়েছেন। তারা বছরের পর বছর আল্লাহ ইবাদাত-বন্দেগিতে কাটাতেন। সে হিসেবে আল্লাহ তাআলা আমাদের দিয়েছেন সল্প আয়ুষ্কাল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা উম্মাতে মুহাম্মাদির জন্য দান করেছেন মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর। এ লাইলাতুল কদর তথা এক রাতকে কোরআনে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। যা রমজানের শেষ দশকের যে কোনো এক রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ হিসেবে গণ্য করা হয়। ইতেকাফে বসা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ لَا تُبَاشِرُوۡهُنَّ وَ اَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ ؕ تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰهِ فَلَا تَقۡرَبُوۡهَا ؕ
‘...আর তোমরা মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না। এটা আল্লাহর সীমারেখা, সুতরাং তোমরা তার নিকটবর্তী হয়ো না।...’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১৮৭)
ইতিকাফে বসার অর্থই হচ্ছে, রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে অবস্থান করা এবং এই দিনগুলোকে আল্লাহর জিকিরের জন্য নির্দিষ্ট করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ার জীবনে রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করে গেছেন। (বুখারি, মুসলিম)
ইতেকাফের মাসায়িল
১. মুমিন বান্দাদের জন্য ২০ রমজান সূর্যাস্তের আগে অর্থাৎ ইফতারের আগেই ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে পৌঁছে যাওয়া আবশ্যক।
২. ইতেকাফের জন্য নিয়ত করা আবশ্যক। এক সঙ্গে দশদিনের জন্য নিয়ত না করলে সুন্নাত ইতেকাফ আদায় হবে না, বরং তা নফলে পরিণত হবে।
৩. মাসনুন ইতেকাফের নিয়ত করলে অবশ্যই তা পূর্ণ করা আবশ্যক। ওজর ছাড়া তা ভঙ্গ করা বৈধ নয়।
৪. ইতেকাফকারীর জন্য ইতেকাফ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করা হারাম। আল্লাহ বলেন-
وَ لَا تُبَاشِرُوۡهُنَّ وَ اَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ ؕ تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰهِ
‘আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১৮৭) এমনকি স্ত্রীকে চুমু খাওয়া, আলিঙ্গন করাও বৈধ নয়।
৫. মাসনুন ইতেকাফ শুরু করার পর কোনো ব্যক্তির যদি দু’একদিন ভঙ্গ হয়ে যায়, তখন ভঙ্গ দিনের ইতেকাফ পরে কাজা করে নিতে হবে।
৬. পারিশ্রমিক বা ইফতার-সেহরির বিনিময়ে ইতেকাফ করা ও করানো কোনোটিই বৈধ নয়।
৭. ইতেকাফকালীন কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ তাহলিল করা, দ্বীনি মাসআলা-মাসায়েল আলোচনা করা, নিজে শিক্ষা অর্জন করা এবং অন্যকে শিখানো উত্তম এবং বৈধ।
৮. চুপচাপ থাকাকে ইবাদাত-বন্দেগি মনে করে চুপ থাকলে ইতেকাফ মাকরূহ হবে। তাছাড়া মুখের গুনাহসমূহ হতে বিরত থাকতে চুপ থাকা বড় ইবাদাত।
৯. ইতেকাফের স্থানকে ব্যবসাস্থল বানানো মাকরূহ। ওয়াজিব ইতেকাফ ফাসিদ বা বাতিল হয়ে গেলে তার কাজা আদায় করা ওয়াজিব। ইতেকাফকারী নিজের কারণে ফাসিদ/বাতিল হোক অথবা হায়েজ (ঋতুস্রাব) বা নিফাসের (রক্তস্রাব) কারণে বাতিল হোক। পরবর্তীতে তা আদায় করা ওয়াজিব।
১০. নারীরা নিজেদের ঘরে ইতেকাফের স্থানকে কাপড় দিয়ে পর্দা টেনে নেবে, যাতে বেগানা পুরুষসহ যে কেউ আসলে ইতেকাফের স্থান ত্যাগ না করতে হয়।
ইতেকাফের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
রমজানের ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। রমজানের বাইরে অন্য সময় ইতেকাফের জন্য রোজা শর্ত নয়। রমজানে শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা। ন্যূনতম শেষ তিন দিন ইতেকাফ করা। রমজানের বাইরে ইতেকাফের নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নেই।
ইতেকাফ বৈধ হওয়ার শর্ত
১. মুসলমান হওয়া;
২. জ্ঞানবান হওয়া; প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া ইতেকাফের জন্য শর্ত নয় বরং জ্ঞানবান নাবালিগের জন্যও ইতেকাফ সহিহ হবে।
৩. জানাবাত (অপবিত্রতা), হায়েজ (ঋতুস্রাব) ও নিফাস থেকে পবিত্র হওয়া।
৪. নারীর ইতেকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি শর্ত। স্বামী অনুমতি দেওয়ার পর ইতেকাফ থেকে বারণ বা বিরত রাখা যাবে না।
ইতেকাফের স্থান
১. ইতেকাফ এমন মসজিদে করা যেখানে নামাজের জামাত হয়।
২. ইতেকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদুল হারাম (বাইতুল্লাহ)।
৩. এরপর মসজিদে নববি (মদিনা)।
৪. এরপর বাইতুল মুকাদ্দাস (মসজিদে আকসা)।
৫. যে কোনো জামে মসজিদ।
৬. যে মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বেশি হয়।
৭. নারীরা নিজ নিজ ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে ইতেকাফ করবে। মসজিদে নারীর জন্য ইতেকাফ করা বৈধ নয়।
ইতেকাফের আদব
১. ইতেকাফ করাকালীন সময়ে নেক কথা ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কথা না বলা। শ্রেষ্ঠ মসজিদকে ইতেকাফের জন্য নির্ধারিত করা।
২. ইতেকাফ অবস্থায় কোরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন, হাদিস অধ্যয়ন, দ্বীনি ইলম শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়া।
সর্বোপরি দুনিয়ার কাজ-কর্ম থেকে বিরত থেকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও লাইলাতুল কদর পেতে ইবাদাত-বন্দেগিতে মশগুল থাকাই হলো ইতেকাফের আদব।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইতেকাফের বিষয়গুলো যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। বিশেষ করে লাইলাতুল কদর পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।