মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের পর আরেকটি টোল সড়ক পেতে যাচ্ছে রাজধানীবাসী। বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর মধ্যে নির্মাণাধীন ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’র সর্বনিম্ন টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা। প্রাইভেট কার, জিপ, মাইক্রোবাস, ট্যাক্সির মতো হালকা শ্রেণীর যানবাহনের জন্য টোলের এ হার ধার্য করা হয়েছে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ ৬২৫ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে বড় ট্রাকের (ছয় চাকার বেশি) জন্য। চলতি বছরের মধ্যে এক্সপ্রেসওয়েটির বিমানবন্দর-তেজগাঁও অংশ চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
এক্সপ্রেসওয়েটিতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো দুই ও তিন চাকার কোনো যানবাহন এ উড়ালসড়কে চলতে পারবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলের জন্য যানবাহনের চারটি শ্রেণী নির্ধারণ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হালকা যানবাহন। এ শ্রেণীর যানবাহনের জন্য সর্বনিম্ন টোল ১০০ টাকা। এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর শেষ পর্যন্ত না গেলে হালকা শ্রেণীর যানবাহন থেকে এ পরিমাণ টোল আদায় করা হবে। অন্যদিকে এক্সপ্রেসওয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করা হালকা যানবাহন থেকে টোল আদায় করা হবে ১২৫ টাকা। হালকা শ্রেণীর যানবাহনকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায়ের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে।
এ ভিত্তি টোলের দ্বিগুণ আদায় করা হবে বাস থেকে। এ হিসাবে এক্সপ্রেসওয়ের কিছু অংশ ব্যবহারের জন্য বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা। আর পুরো এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে চাইলে গুনতে হবে ২৫০ টাকা।
একইভাবে ভিত্তি টোলের চার গুণ নির্ধারণ করা হয়েছে মাঝারি (ছয় চাকা পর্যন্ত) আকারের ট্রাকের জন্য। এ হিসাবে এক্সপ্রেসওয়ের কিছু অংশ ব্যবহার করলে ৪০০ টাকা এবং পুরো অংশ ব্যবহার করলে মাঝারি ট্রাক থেকে টোল আদায় করা হবে ৫০০ টাকা।
বড় ট্রাকের জন্য (ছয় চাকার বেশি) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ভিত্তি টোলের পাঁচ গুণ। এ হিসাবে কিছু অংশ ব্যবহারের জন্য ৫০০ টাকা এবং পুরো এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের জন্য ৬২৫ টাকা টোল আদায় করা হবে বড় ট্রাক থেকে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) পদ্ধতিতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক কনগ্লোমারেট প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, চীনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন। এর মধ্যে ইতাল-থাইয়ের শেয়ার ৫১ শতাংশ। শ্যানডংয়ের শেয়ার ৩৪ আর সিনোহাইড্রোর শেয়ার ১৫ শতাংশ। এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠন করা হয়েছে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামের একটি বেসরকারি কোম্পানি। চুক্তি অনুযায়ী, এ এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাল সাড়ে তিন বছর। নির্মাণ-পরবর্তী সাড়ে ২১ বছর টোল আদায় করবে এ কোম্পানি। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শেয়ার অনুযায়ী লভ্যাংশ পাবে। চুক্তিবদ্ধ সময় শেষ হলে এক্সপ্রেসওয়েটি চলে আসবে বাংলাদেশ সরকারের মালিকানায়।
বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো থেকে টোল আদায়ের জন্য সরকারের একটি নীতিমালা রয়েছে। ২০১৪ সালে প্রণীত এ নীতিমালায় টোলহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবকাঠামোর নির্মাণ ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, ডিজাইন, যানবাহনের সংখ্যা, আকার, সড়কের শ্রেণী, প্রযোজ্য বিভিন্ন কর, ভ্যাট, শুল্ক, লেভি, সারচার্জ ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা হয়েছে। টোল নীতিমালায় সর্বোচ্চ টোল নির্ধারণ করা আছে কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা। গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের জন্য এ টোলহার প্রযোজ্য।
অন্যদিকে পিপিপি পদ্ধতিতে নির্মিত স্থাপনার টোলের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, পিপিপির আওতায় নির্মিত স্থাপনাগুলোর টোল আরোপ, আদায় পদ্ধতি ও হার সরকার ও অর্থ বিনিয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী হবে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষেত্রে টোলহারটি নির্ধারিত হয়েছে বিনিয়োগকারী সংস্থা ও সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্ববধানে। এক্সপ্রেসওয়ের টোলহার নির্ধারণের বিষয়ে জানতে চাইলে এর প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ টোলহার আগে থেকেই নির্ধারণ করা। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ অবকাঠামো থেকে সাড়ে ২১ বছর টোল আদায় করবে। এক্সপ্রেসওয়েটি চালুর বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি।’
প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কাওলা থেকে বনানী পর্যন্ত অংশটির কাজ আমরা এরই মধ্যে ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশ শেষ করে এনেছি। বনানী পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের সব অবকাঠামো প্রায় প্রস্তুত হয়েছে। অন্যদিকে বনানী থেকে মগবাজার অংশের কাজ ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। আর মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত অংশের অগ্রগতি ৫ শতাংশ। সে হিসাবে পুরো প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ।’
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রায় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে উড়ালসড়কটি নির্মাণে। এক্সপ্রেসওয়ের নকশায় সংস্থান রাখা আছে ৩১টি র্যাম্প, যেগুলোর দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। সরকারের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (আরএসটিপি) তথ্যানুযায়ী, বাস্তবায়নের পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে। পুরো এক্সপ্রেসওয়েতে থাকবে ১১টি টোলপ্লাজা। এর মধ্যে পাঁচটি হবে এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো এগিয়ে নিতে ৪ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প (সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) বাস্তবায়ন করছে সেতু কর্তৃপক্ষ। এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।