কেস ডায়েরি (সিডি) খোলা থেকে শুরু করে চার্জশিট দাখিল পর্যন্ত হত্যা মামলার তদন্তে সময় লেগেছে মাত্র ২৪ ঘণ্টা। এই সময়ের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) কী কী করেছেন সেটা সিডিতে লিখে রেখেছেন। সেই সিডি পর্যালোচনায় হাইকোর্ট দেখতে পেয়েছেন যে, মাত্র দুই ঘণ্টায় আইও মামলার ১৩ জন সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন। আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করতে পাঠিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। রকেট গতিতে মানিকগঞ্জের একটি হত্যা মামলার তদন্তে ত্রুটি পরিলক্ষিত হওয়ায় এবং আদালতের সামনে মিথ্যাচার করায় তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাসুদুর রহমানকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপারকে এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত রিভিশন মামলার শুনানি শেষে বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসেন দোলনের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার (৩ এপ্রিল) এই আদেশ দেন।
এছাড়া মামলার অধিকতর তদন্ত করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন্সকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। পুলিশ সুপার পদমর্যাদার নিচে নয় এমন কর্মকর্তা দিয়ে মামলাটি তদন্ত সম্পন্ন করতে পিবিআই প্রধানকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে এই হত্যা মামলার বিচার কাজ স্থগিত করেছে হাইকোর্ট।
আদেশের পর তদন্ত কর্মকর্তাকে সতর্ক করে দিয়ে হাইকোর্ট বলেন, নিজেকে কখনো আইনের ঊর্ধ্বে মনে করবেন না। কত বড় তদন্ত কর্মকর্তা হয়েছেন, কোর্টের সামনে ক্ষমতা দেখান, মিথ্যাচার করেন। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী বরখাস্তের আদেশ পুনঃবিবের্চনার আদালতকে অনুরোধ জানান। তখন হাইকোর্ট বলেন, আদালতের সামনে তদন্ত নিয়ে মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় তাকে (আইও) জেলে পাঠানো উচিত ছিল। কিন্তু সেটা না করে তাকে সামান্য শাস্তি দিয়েছি মাত্র। পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সে সাসপেন্ড থাকবেন।
গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত মধ্য রাতে মানিকগঞ্জ সদরের কৈতরা গ্রামের একটি হ্যাচারিতে খুন হন মো. রুবেল (২২)। পরদিন নিহতের স্ত্রী চম্পা বাদী হয়ে সোহেল ওরফে নুরন্নবীকে আসামি করে সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। আসামি সোহেল মামলার বাদী চম্পার খালাতো ভাই। সেই মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে সোহেল। নিম্ন আদালতে জামিন না পাওয়ায় হাইকোর্টে ফৌজদারি রিভিশন মামলা করেন। পাশাপাশি মামলার বাদী চম্পাও মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করেন। তিনি আবেদনে বলেন, উনি নিজে থেকে এই মামলা করেননি। তার কাছ থেকে শুধু সাদা কাগজে সাক্ষর নিয়েছে পুলিশ। সেই মামলার শুনানিতে তদন্ত কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানকে তলব করে হাইকোর্ট।
শুনানিতে হাজির হন আইও মাসুদ। শুনানিতে তাকে বেশ কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে হাইকোর্ট। তখন আইও আদালতে বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি ১৩ জন সাক্ষীর জবানবন্দি সিআরপিসির ১৬১ ধারায় রেকর্ড করেছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যান।
কিন্তু চম্পার কৌসুলি অ্যাডভোকেট শিশির মনির আদালতে বলেন, আইওর এই বক্তব্য সত্য নয়। উনি (আইও) ঘটনাস্থলে ৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ৪৫ মিনিটে রেকর্ড করেছেন। ৮৫ মিনিটে ৮ জন সাক্ষীর জবানবন্দি থানায় রেকর্ড করেছেন। এই জবানবন্দি হাতে লিখতে হয়। এত অল্প সময়ে একজন মানুষের পক্ষে ১৩ জনের জবানবন্দি রেকর্ড করা কি সম্ভব? এছাড়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন আসামিকে হাজির করেছেন আইও।
শিশির মনির বলেন, গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে খুনের ঘটনা ঘটে। এজাহার দাখিল হয়েছে ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে। তদন্ত কর্মকর্তা কেস ডায়েরি ওপেন করেছেন ওইদিন ৭টা ২৫ মিনিটে। এই কেস ডায়েরি ওপেন করার আগেই তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে ফেলেছেন। অর্থাৎ কেস ডায়েরি থেকে চার্জশিট দাখিল পর্যন্ত সময় লেগেছে মাত্র ২৪ ঘণ্টা।
আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, এরকম স্মার্ট তদন্ত কর্মকর্তাই তো দরকার! এ সময়ের মধ্যে উনি কখন সাক্ষী নিলেন, কখন ঘুমালেন, কখন খাওয়া-দাওয়া করলেন সেটাও ভাবার বিষয়।
রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) সুজিত চ্যাটার্জি বলেন, চার্জশিট দ্রুত দিলেও সমস্যা। আবার দেরি করে দিলেও সমস্যা। আদালত বলেন, তাহলে আমরা একটা মক ট্রায়াল করি। কত দ্রুত চার্জশিট দিতে পারেন, সেটা দেখতে চাই। ডিএজি বলেন, সেটা দেখার এখতিয়ার আপনাদের আছে। আদালত বলেন, এই আইও আমাদের সামনে হাজির হয়ে এক ধরনের কথা বলেছেন। আর মামলার নথিতে রয়েছে ভিন্ন কিছু। এটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নাই। এরপরই হাইকোর্ট আদেশ দেন।
তিন প্রশ্নকে সামনে রেখে তদন্ত করতে হবে পিবিআইকে
হাইকোর্ট তিন প্রশ্নকে সামনে রেখে পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রথমত, বাদী বলেছেন তিনি মামলা করেননি। সাদা কাগজে তার সাক্ষর নেওয়া হয়েছে? দ্বিতীয়ত, দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে চার্জশিট দিতে গিয়ে কোন অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে কিনা? তৃতীয়ত, এই মামলার তদন্তে তৃতীয় পক্ষ তদন্ত কর্মকর্তাকে ব্যবহার করেছে কিনা সেটা খুঁজে বের করা।