২৮ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৫:৫০:২৮ পূর্বাহ্ন


নির্ধারিত সময়ের আগেই মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন পরিকল্পনা
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৪-২০২৩
নির্ধারিত সময়ের আগেই মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন পরিকল্পনা নির্ধারিত সময়ের আগেই মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন পরিকল্পনা


কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে নির্মাণ হচ্ছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জাইকা) সহায়তায় নির্মাণাধীন প্রকল্পটির বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বন্দর নির্মাণকাজের ভৌত অগ্রগতি ৯১ শতাংশের বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত বাকি প্রকল্পগুলো মিলিয়ে সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৩ শতাংশ। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কমিশনিংয়ের কথা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। তবে বর্তমানে যে গতিতে কাজ এগোচ্ছে, তাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা যাবে বলে জানিয়েছে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরাও চাইছেন নির্ধারিত সময়ের আগেই তা শুরু করে দিতে।


প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বর্তমানে কেন্দ্রের কমিশনিং সংক্রান্ত নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলছে। তবে এর সঙ্গে আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্পের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে উৎপাদন চালু করা সম্ভব।

সিপিজিসিবিএল সূত্রে জানা গেছে, প্যাকেজ ১ ও ২-এর আওতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বন্দর নির্মাণ, চ্যানেল রিভেটমেন্ট, সেডিমেন্ট মিটিগেশন ডাউক, সিওয়াল নির্মাণ এবং ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রের পাওয়ার হাউজ, বয়লার, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও ফ্যাসিলিটিজের নির্মাণকাজ চলমান। এর আগে মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে চকরিয়া-মাতারবাড়ী ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন ও মাতারবাড়ী ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিজিসিবিএলের নির্বাহী পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার আগেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আনার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। সেটিকে সামনে রেখে দ্রুতই কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টেস্টিং ও কমিশনিং হবে। এছাড়া মাতারবাড়ী পোর্টের কাজও প্রায় শেষ দিকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেটি দ্রুত হস্তান্তর করা হবে।’

ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি করতে না পারায় সম্প্রতি পায়রা ও রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। তাই মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র দ্রুতই উৎপাদনে আসার সুখবর দিলেও জ্বালানি নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থেকেই যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘জাপানের সিংহভাগ অর্থায়নে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে। ফলে কয়লার ব্যবস্থাও তারা করছে। পরবর্তী সময়ে সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে।’

সিপিজিসিবিএল সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প। এটির কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট। এরপর ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরু থেকেই কাজ চলছে বিশেষ তদারকির মাধ্যমে। তবে এ প্রকল্পে শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রই নয়; এর আওতায় কেন্দ্রের কয়লা লোড-আনলোড জেটি, টাউনশিপ, সঞ্চালন লাইন এবং সংযোগ সড়ক নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত। ফলে একই সক্ষমতার অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে এটি ব্যয়বহুল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকার অর্থায়ন রয়েছে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। বাকি ৭ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও সিপিজিসিবিএলের নিজস্ব অর্থায়ন। আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি মেনে নির্মিতব্য তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য ১ হাজার ৬০৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে মাতারবাড়ী জয়েন্ট ভেঞ্চার কনসালট্যান্ট (এমজেভিসি)। প্রতিষ্ঠানটির পরামর্শ অনুযায়ীই প্রণয়ন করা হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বন্দরের নকশা। এ প্রকল্পে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএইচআই করপোরেশনের কনসোর্টিয়াম। এছাড়া উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্য মাতারবাড়ী-মদুনাঘাট ১০০ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করেছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ লাইন প্রস্তুত করা হয়। এরই মধ্যে পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে পিজিসিবি। বতর্মানে  লাইনটি মাতারবাড়ী থেকে বিদ্যুৎ নেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।


সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. এনামুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাতারবাড়ী থেকে বিদ্যুৎ নেয়ার জন্য লাইনটি পুরোপুরি প্রস্তুত। বর্তমানে এ সঞ্চালন লাইন দিয়ে পিজিসিবি বাঁশখালী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। মাতারবাড়ী চালু হলে এ লাইন দিয়ে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।’

দেশে বর্তমানে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রয়েছে। এর একটি পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এবং অন্যটি বাগেরহাটের রামপালে একই সক্ষমতার মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) নির্মিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ৬৬০ মেগাওয়াট উৎপাদনে রয়েছে। মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এলে দেশে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বৃহৎ তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে যাবে।

বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বর্তমানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ৩ হাজার ৪৭২ মেগাওয়াট। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এলে দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৪ হাজার ৬৭২ মেগাওয়াট। আর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট।

দেশে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দ্রুত উৎপাদনে আসলে বাংলাদেশ ব্যয়বহুল জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসতে পারবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় খরচ কম হলে কোল পাওয়ার প্লান্ট আর্থিকভাবে বিপিডিবিকে সাশ্রয়ী করবে। আর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমালে কয়লা অন্তত তিন-চার বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বস্তি দেবে। ২০২৭ সালের মধ্যে সাত হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এরই মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। বাঁশখালীর বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এলে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। কয়লার জোগান নিশ্চিত ও সাশ্রয়ী মূল্য পেলে এবং সার্বক্ষণিক এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সুবিধা দেবে।’