২৮ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৫:৩৮:৫২ পূর্বাহ্ন


দুই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রুপিতে
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০৪-২০২৩
দুই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রুপিতে ফাইল ফটো


ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশর দুই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যে রুপির ব্যবহার শুরু হতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রায় শেষ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্তের পরই উভয় দেশে এর ব্যবহার চালু হবে। ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) মোট বাণিজ্যের হিসাব প্রস্তাব আকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জমা দিয়েছে। বিদ্যমান ডলার সংকট কাটাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিষয়, মন্ত্রিসভায় লিখিত আকারে তুলে ধরেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সেখানে তিনি দুদেশের বাণিজ্য বিনিময় মাধ্যম ডলারের বিপরীতে রুপির ব্যবহারের বিষয়টি অবহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রীকে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখ্য কর্মকর্তা মেজবাউল হক যুগান্তরকে জানান, ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য বিনিময় মাধ্যম ডলারের বিপরীতে রুপির ব্যবহারের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়ে আছে। আরও কিছু দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে সিদ্ধান্তের বিষয় আছে। এরপর ব্যাংকগুলোকে প্রস্তুত করতে হবে। তবে এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে।

এলসি খোলার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বার্ষিক ডলারে কোটা থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন অনুযায়ী এলসি খুলবে। তবে আমাদের রুপি পাওয়ার একমাত্র উৎস ভারতে আমাদের পণ্য রপ্তানি আয় থেকে। সে দিক থেকে কিছুটা কম হচ্ছে। ভারত থেকে আমরা আমদানি বেশি করি। এজন্য বাণিজ্য ঘাটতি থাকে। ফলে আমদানির জন্য সে পরিমাণ রুপির প্রয়োজন হবে সেটি থাকতে হবে। এদিকটিও ভাবা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রুপির মাধ্যমে বাণিজ্য শুরু হলে এ দেশের ব্যবসায়ীদের ভারতে একটি ব্যাংকে হিসাব খুলতে হবে। সেই হিসাব খোলা হবে রুপিতে। এখান থেকে রপ্তানি পণ্যের মূল্য রুপিতে ওই ব্যাংকে পরিশোধ করা হবে। আবার আমদানি করলে ওই রুপি দিয়ে আমদানির এলসি মূল্য শোধ করা হবে।

কোভিড-১৯-এর ধাক্কার পাশাপাশি প্রায় এক বছর ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে দেশে ডলারের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সংকটও তৈরি হয়েছে ডলারের। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দাম। তাতে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। ফলে ডলার-সংকট আরও প্রকট হয়। এমন পরিস্থিতিতে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে ভারত। ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালায়, সেটিকে আর্থিক পরিভাষায় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’ বলা হয়।

জানা গেছে, রাশিয়া, মরিশাস, ইরান ও শ্রীলংকার সঙ্গে ভারত রুপিতে বাণিজ্যও শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য বাণিজ্য সংগঠন ও ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিতে থাকে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে বাণিজ্যের মাধ্যম হিসাবে ১৯৬০-এর দশকে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান এসব দেশ ভারতীয় রুপি গ্রহণ করত। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।

গত ২২-২৩ ডিসেম্বর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকে উভয় দেশের বাণিজ্য বিনিময় মাধ্যম হিসাবে রুপি চালুর প্রস্তাব দেয় ভারত। এরপর গত ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত জি-২০ অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরদের বৈঠকের ফাঁকে বিনিময় মুদ্রা হিসাবে ডলারকে সরানো নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়। সেখানে ডলার সরিয়ে টাকা ও রুপিতে লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এবং ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস এমন একটি ব্যবস্থার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

ডলারের বিপরীতে রুপিতে বাণিজ্য প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আমি ভারতে বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকে যোগ দিলে সেখানে ভারত আমাকে এ প্রস্তাব দেয়। তবে আমি বলেছি প্রস্তাব খতিয়ে দেখবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। আরও পর্যবেক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

বিদায়ি ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে প্রায় ২শ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। বিপরীতে ভারত থেকে এক হাজার ৬১৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৪২০ কোটি ডলারের মতো। দুদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ যেহেতু কম, তাই রুপি ও টাকার লেনদেনে ভারত লাভবান হলেও বাংলাদেশ চাপে থাকবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ যদি ভারতের সঙ্গে রুপি-টাকায় লেনদেনে যায়, তাহলে সেটা একপক্ষীয় মুদ্রা বা রুপিভিত্তিক বিনিময় কাঠামোয় উপনীত হতে পারে এবং বাংলাদেশের ওপর অধিক হারে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহারের চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রুপি ও টাকায় লেনদেনে উদ্যোগের বিষয়টি স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। কারণ চলতি বছর বিশ্বজুড়ে ডলারের দর ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। ফলে উভয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ে। এমন অবস্থায় শতভাগ না হলেও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের আংশিক রুপি-টাকায় লেনদেন করা হলে দুই দেশই সুবিধা পাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা। পাশাপাশি ডলারের দাম ওঠানামা করায় দুই দেশের বাণিজ্যে গতি আনতে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন উভয় দেশের জন্যই সুবিধাজনক হবে। ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমবে।

বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই)। এ প্রসঙ্গে জানতে মক্কায় অবস্থানরত আইবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট মাতলুব আহমেদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে যুগান্তর। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে জানান, ভারতের সঙ্গে ডলারের বিপরীতে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দুই বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য পণ্য আমদানির এলসি খোলার কাজটি সহজ হবে। এখন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের অর্থ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে উভয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিভাইস প্রয়োজন।

এ উদ্যোগকে ঊভয় দেশের ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানায়। এর আগে গত ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এফসিসিআইয়ের বিজনেস সম্মেলন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে আইবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের কাছে একটি প্রস্তাব চেয়েছে। আমরা দুই বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে রুপিতে বাণিজ্য হতে পারে এ প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা আরও বলেছি, এটি কার্যকর হলে ডলারের ওপর চাপ কমবে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে।

জানা যায়, ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান তখন পড়ছিল। পরে অবশ্য সেই উদ্যোগ সফল হয়নি।

বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সিনিয়র সহসভাপতি মো. হাতেম বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবধান অনেক বেশি। ফলে ভারতের প্রস্তাব তত্ত্বগতভাবে ঠিক হলেও বাস্তবে কঠিন হতে পারে। ভারত থেকে ২০০ কোটি ডলারের যে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ করে, সে পরিমাণ বাণিজ্য ভারতীয় মুদ্রায় করার কথা ভাবা হচ্ছে। সেটি হলেও এক হাজার কোটি ডলারের বেশি যে আমদানি ব্যয়, তা ডলারেই করতে হবে।