২৮ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৫:৪২:১৯ পূর্বাহ্ন


খুলনা-মোংলা রেলপথ, সুবর্ণভূমির হাতছানি
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০৪-২০২৩
খুলনা-মোংলা রেলপথ, সুবর্ণভূমির হাতছানি File Photo


পর্যটন শিল্পে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন আর সমুদ্রবন্দর মোংলা ‘সুবর্ণভূমি’ হয়ে ওঠার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে যাচ্ছে ‘খুলনা-মোংলা রেলপথ’। পদ্মা সেতুর পর এ রেললাইন চালু হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। আর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে। যা জিডিপিতে বড় অবদান রাখবে। একদা মৃতপ্রায় মোংলাবন্দর হয়ে উঠবে বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম ব্যস্ত বন্দর।

সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের আধার বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আট প্রহরে ছয় রূপ ধারণ করা সুন্দরবন হয়ে উঠবে পর্যটকে মুখরিত। পর্যটন খাতে রাজস্ব বাড়বে। সর্বোপরি এ রেল পথ ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বে আর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পূরণ হবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারের আরও একটি প্রতিশ্রুতি।   
চার হাজার ২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘খুলনা থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে’র কাজ ৯৭ শতাংশ শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পের গত এক যুগে প্রথম ইঞ্জিন চলেছে। খুলনা-মোংলা লাইনের ফুলতলা অংশের ডাইভার্সন লাইন ও লুক লাইনের সঙ্গে প্রধান লাইনের সমন্বয় করতে পরীক্ষামূলকভাবে ৫ কিমি পথে রেল ইঞ্জিন চালানো হয়। বাকি কাজ আসছে জুন মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হবে বলে প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান।


‘আধুনিক রামপাল-মোংলার জনক’ খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের প্রত্যাশিত ছিল খুলনা-মোংলা রেলপথ। যা মোংলাবন্দর প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পর পূরণ হতে যাচ্ছে জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তায়। এ রেললাইন চালু হলে মোংলাবন্দর ব্যবহার করে পার্শ^বর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সরাসরি আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হবে। একইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে অনেক গতি আসবে। ফলে এক সময়ের অবহেলিত এবং মৃতপ্রায় মোংলাবন্দর বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বন্দরে রূপ নেবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হবে। সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী হবে দেশের অর্থনীতি।’
খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ট্রেজারার সুজন শিক্ষাবিদ ও লেখক অমিত রায় চৌধুরী বলেন, এ রেল পথ চালু হলে চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীসহ প্রতিদিন যাতায়াতকারী মানুষের ভোগান্তি অনেকাংশে হ্রাস পাবে। স্বস্তিতে মানুষ যাতায়াত করতে পারবেন। গ্রামীণপণ্য পরিবহন সহজ হবে। তাছাড়া মোংলাবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে সুন্দরবনে পর্যটদের আগমন বাড়বে। তাঁর ভাষায়, পদ্মা সেতুর পর এ আর এক অসাধারণ অর্জন। এভাবে একের পর এক প্রতিশ্রুতি, মানুষর চাওয়া পূরণ হচ্ছে। এভাবেই আমাদের দেশ জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বাগেরহাট-খুলনা রেলপথ চালুর আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

রামপাল-মোংলা আসনের সংসদ সদস্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, খুলনা-মোংলা রেললাইন চালু হলে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর একটি বড় প্রত্যাশা পূরণ হবে। আমি এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে নিয়মিত এ কাজের দেখাশুনা করি। মোংলা বন্দর প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পর এত বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ধারাবাহিক ক্ষমতায় আছেন বলে। বিএনপি-জামায়াত আমলে আমাদের এ অঞ্চল (দক্ষিণাঞ্চল) সবচেয়ে অবহেলিত ছিল বলে তিনি উল্লেখ করে আরও বলেন, আজ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার মান পাল্টে গেছে, অনেক উন্নত হয়েছে। এ রেলপথ চালু হলে আরও সমৃদ্ধি আসবে।   
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম বলেন, এ রেললাইন চালু হলে সবদিক থেকে উপকার হবে। মানুষ এটাই চায়।
সাবেক সংসদ সদস্য রাকসার প্রাক্তন ভিপি অ্যাডভোকেট মীর শওকাত আলী বাদশা বলেন, এ রেললাাইন চালুর সঙ্গে সঙ্গে মোংলা বন্দরের ব্যস্ততা বহুগুণ বাড়বে। অনেক মানুষের বেকারত্ব মোচন হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশেষ করে পণ্য পরিবহনে খুব সুবিধা হবে।

তাঁর ভাষায়, ‘বাগেরহাট হবে প্রাচ্যের সিঙ্গাপুর।’ তিনি এ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।’ প্রায় অনুরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন, বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ড. একে আজাদ ফিরোজ টিপু ও বাগেরহাট ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আহাদ উদ্দিন হায়দার।  
খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণের অত্যতম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনালের সহকারী মহাব্যবস্থাপক গিরিশ চন্দ্র ত্রিবেদী বলেন, প্রথম ট্রায়াল শেষ হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে মোংলা পথে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শেষ করার লক্ষ্যে দ্রুত গতিতে কাজ চলছে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি দ্রুত কাজ শেষ করার। 
ইরকন ইন্টারন্যাশনালের উপ-মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার বিশ^াস বলেন, অনেকরকম প্রতিকূল পরিবেশ আসার পরও আমরা এটাকে কমপ্লিট করেছি। মাসখানেকের মধ্যে আমরা চেষ্টা করছি মোংলাবন্দর পর্যন্ত যাওয়ার।
রূপসা নদীর ওপর ৫.১৩ কিমি দীর্ঘ রেল সেতুর নির্মাণ কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। ১১টি প্ল্যাটফর্মসহ ৯১ কিমি রেললাইন বসানোর কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। শেষ হয়েছে ১০৭টি ছোট ব্রিজ ও ৯টি আন্ডার পাস রোড। শেষ সময়ে এখন বাকি অংশের রেলপথ এবং সিগলালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ চলছে। 
খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি। তারপরই উদ্বোধনের ব্যবস্থা করা হবে।
ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির আওতায় খুলনা মোংলা রেললাইন প্রকল্পের অর্থায়ন করছে ভারত সরকার। ইনকর ইন্টারন্যাশনাল ছাড়াও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান রার্সেন অ্যান্ড টার্বো এবং আর ট্রাক লিংকিং নামে দুটি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মূলত জমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও কয়েকটি জায়গায় মাটির অবস্থান সঠিক না থাকায় এবং করোনা মহামারির কারণে এ প্রকল্পের কাজ তিন দফা পেছানো হয়।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্টিজের পরিচালক, নজরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, এ রেলপথ চালু হলে এ অঞ্চলে অর্থনীতির নতুন দ্বার খুলবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।’  
মোংলা বন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতা খন্দকার সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, যত দ্রুত এ রেললাইনের উদ্বোধন হয়, তত দ্রুত আমরা সুবিধা ভোগ করতে পারব। এতদিন রেলপথ না থাকার কারণে মোংলাবন্দরের বড় বড় কন্টেনার পরিবহনে আমাদের সমস্যা হতো।
মোংলা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়াল অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী বলেন, মোংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি রেললাইন যুক্ত হওয়া এ বন্দরের ৭৩ বছরের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা, বড় অর্জন। এর ফলে দেশী-বিদেশী বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। সহজে পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে।

কম খরচে দ্রুত পণ্য পরিবহনের ফলে বন্দর ব্যবহারকারীরা আরও সুবিধা পাবেন। তাদের মধ্যে আরও আগ্রহ সৃষ্টি হবে। পদ্মা সেতু চালুর পর, যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, সক্ষমতা বাড়বে। আসল কথা হলো মোংলাবন্দর বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বন্দরের মর্যাদা পাবে। 
এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান (বিপিএএ) জনকণ্ঠকে বলেন, মোংলা সমুদ্রবন্দরকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় সংযুক্ত করতে এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহন কম খরচে দ্রুত করার লক্ষ্যে খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় ভারত-বাংলাদেশের যৌথ চুক্তিতে এ প্রকল্পে দুটি প্যাকেজ রয়েছে। ৬৪.৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রায় সমাপ্তির পথে। এমব্যাংকমেন্ট, সিভিল ওয়ার্ক, মেজর ও মাইনর ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ ছাড়াও রূপসা নদীর ওপর ৫.১৩ কিমি দীর্ঘ রেল সেতু এখন দৃশ্যমান। এ পথে মোট ১১২টি কালভার্ট, খুলনা ও বাগেরহাট উভয় অংশে ছোট-বড় মোট ৩১টি ব্রিজ রয়েছে। যার মধ্যে বাগেরহাট জেলা অংশে ১৭টি এবং খুলনা জেলা অংশে ১৪টি। ১১টি প্ল্যাটফর্ম, ৯টি আন্ডার পাস রোড ও স্টাফদের জন্য ১৫টি ভবন নির্মিত হয়েছে। তাঁর ভাষায়, ‘আশা করছি আগামী জুনের মধ্যে বাকি অংশের কাজ শেষ হবে। এরপর বহুকাক্সিক্ষত উদ্বোধন।’
তিনি আরও বলেন, ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনা থেকে মোংলাবন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণসহ সম্ভাব্যতা যাচাই নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। দুই দফা ডিপিপি সংশোধনের পর প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ রয়েছে ২ হাজার ৯৪৮ কোটি ১ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। বাকি ১ হাজার ৩১২ কোটি ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকার সরকারি ফান্ড থেকে ব্যয় হবে। 
মোংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড ও জনসংযোগ বিভাগের সচিব কালাচাঁদ সিংহ বলেন, সুন্দরবনের পশুর নদীর জয়মনিগোলে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজ ‘দি সিটি অব লিয়নস’ নোঙ্গর করার মধ্য দিয়ে ১৯৫০ সালে ১১ ডিসেম্বর এ সমুদ্রবন্দরের যাত্রা শুরু হয়। পরে ব্রিটিশ নাগরিক স্যার ক্লাইভ এংনিস পশুর ও শিবসা নদী দীর্ঘ জরিপ করে বন্দরটি চালনা থেকে সরিয়ে মোংলায় স্থানান্তরের সুপারিশ করেন। ১৯৫৪ সালের ২০ জুন বন্দরটি সরিয়ে মোংলায় স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু চালনা বন্দর বলে তখন পরিচিত ছিল। এরপর ১৯৮৭ সালে মার্চ মাসে নাম পরিবর্তন করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের যাত্রা শুরু হয়।
তিনি আরও বলেন, মোংলা একমাত্র সমুদ্রবন্দর যেখানে কোনো রেলপথ নেই। ফলে বড় বড় জাহাজ এখোনে ভেড়াতে আগ্রহী ছিলেন না ব্যবসায়ীরা। এতে আয় অপেক্ষাকৃত কম হতো। যে কারণে এর আগে একাধিকবার মোংলাবন্দরের সঙ্গে রেললাইন যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। যা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থিক সমৃদ্ধি, পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল, ভুটানসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের ভাবনা থেকে এ রেলপথটি নির্মাণ শুরু হয়।’ 
প্রকল্পের সিনিয়র সাব-অ্যাসিন্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মিহির ম-ল বলেন, খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত প্রায় ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটির নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পটি তিনটি ভাগে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম প্যাকেজে রেল লাইন নির্মাণ, প্যাকেজ-দুইয়ে রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু এবং প্যাকেজ-তিনে টেলিকমিউনিকেশন ও সিগন্যালিং সিস্টেম। প্রকল্পের আওতায় লুপ লাইনসহ রেলওয়ে ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য ৮৬ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার। ১০৭টি কালভার্টের মধ্যে ১০৫টি, ৯টি ভিইউপি এবং ২৯ এলসি গেটের ২৭টি কাজ শেষ হয়েছে। 
তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, কয়েকটি জায়গায় মাটির গঠন যথাযথ না থাকা এবং করোনা মহামারির কারণে এ প্রকল্পের করোনাকালে ভারত থেকে মালামাল আসতে বিলম্বসহ নানা সংকটে শুরুতেই নির্মাণকাজে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ ডিফেক্ট লায়ারলিটি পিরিয়ডসহ  ৩১ জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গত ২৭ মার্চ সরেজমিনে দেখা গেছে, ৮টি স্টেশন বিল্ডিংয়ের মধ্যে ফুলতলা, আড়ংঘাটা ও মোহাম্মদনগরের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাটাখালী, চুলকাটি, ভাগা, দ্বিগরাজ ও মোংলা স্টেশনের অধিকাংশ কাজ প্রায় শেষের পথে। আগামী জুনের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে। 
বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু জনকণ্ঠকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত আমলে গোটা দক্ষিণাঞ্চল অবহেলিত ছিল।

তখন কাজ নাপেয়ে মোংলাবন্দর থেকে শত শত শ্রমিক অন্যত্র চলে গিয়েছিল, না খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন অনেকে। জননেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সদিচ্ছায়, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল ক্ষমতায় থাকায় আজ সেই মোংলাবন্দর লাভজনক প্রতিষ্ঠান। ‘খুলনা-মোংলা রেললাইন’ চালু হলে এ সুযোগ আরও কয়েকগুণ বাড়বে। সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতি মজবুত হবে।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, ‘খুলনা-মোংলা রেল পথ চালু হলে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হবে। আমরা দ্রুত এ রেলপথ চালুর অপেক্ষায় আছি।’  
ষাটগম্বুজ ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, প্রায় প্রতিদিন আমাকে খুলনায় যাতায়াত করতে হয়। আমি চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীসহ এ অঞ্চল থেকে নিয়মিত যাতায়াত করা মানুষের ভোগান্তি দেখি, আমি নিজেও সেই ভোগান্তির শিকার। এ রেল পথ চালু হলে সেই ভোগান্তি অনেকাংশে থাকবে না। স্বস্তিতে মানুষ যাতায়াত করতে পারবেন। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ হিসেবে আর একটি স্বপ্নের দুয়ার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে, এতে খুব আনন্দ বোধ করছি। ট্যুরিজম এবং মোংলাবন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসার নতুন দিগন্ত উন্মোচনের এমন কার্যকর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করায় বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।
মেডিক্যাল শিক্ষার্থী দিব্যাদীপ্তি দাশ ও আসিফ রহমান বলেন, উপকূলীয় আমাদের এ অঞ্চল দুর্যোগ প্রবণ এলাকা। ঝড়, বৃষ্টি বা অন্য কোনো দুর্যোগের সময় আমাদের যাতায়াত করতে খুব কষ্ট হয়, বাস ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এ রেল পথ চালু হলে আমাদের সেই কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে। তবে তারা বাগেরহাট-রূপসা রেল লাইন চালুর জোর দাবি জানান। 
বাগেরহাট চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি সুমন ফকির বলেন, দেশের সিংহভাগ চিংড়ি বাগেরহাটে উৎপাদন হয়। যে কারণে এ জেলাকে ‘সাদা সোনা’র জেলা বলা হয়। রপ্তানি বাণিজ্যে এর আবদান অনেক। কিন্তু পরিবহন বা আনা-নেওয়ার ঝামেলার কারণে খরচ অনেক বেশি হয়। কিন্তু ‘খুলনা-মোংলা রেললাইন’ চালু হলে আমাদের এ অঞ্চলের চাষিদের অনেক উপকার হবে, খরচ কমবে। সহজে মাছ রপ্তানি করা যাবে। 
গত বছরের ৪ জুলাই সরেজমিনে খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তখন তিনি বলেন, মোংলা সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের সরকার খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করছে। খুলনা-মোংলা রেলপথে যাত্রী পরিবহনসহ মোংলাবন্দরের মালামাল পরিবহন সহজ হবে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা হয়ে ভারতের শিলিগুড়ির সঙ্গে এ রেল যোগাযোগ সরাসরি সংযুক্ত হবে।

এর ফলে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে মোংলাবন্দর ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বাড়বে। এটা আমাদের অর্থনীতিকে আরও সচল করবে। ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের আর একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। আগামী জুনের পর এ রেলপথ চালু করা যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।