রাজনৈতিক দলের মতানৈক্যের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে মাঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। পাশাপাশি বিএনপির মতো সংলাপ বর্জন করা আরও আট রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য ফের আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইসি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে ইসি সচিবালয়ের সমন্বয় সভা হয়। সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য চার নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। এতে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। সভায় কর্মকর্তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়ে নির্দেশনা দেন সিইসি।
আগামী ডিসেম্বরে কিংবা জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। নির্বাচনকেন্দ্রিক রোডম্যাপ ঘোষণার সাড়ে ছয় মাস পারও হয়ে গেছে। হাতে সময় আছে আর সাত মাস। এমন পরিস্থিতিতে ইসি সচিবালয় কোনোভাবেই যেন নির্বাচনী প্রস্তুতিতে পিছিয়ে না পড়ে, সভায় সে নির্দেশনা দিয়েছেন সিইসি।
সভা শেষে ইসি সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আজ আমাদের মাসিক সমন্বয়সভা ছিল। ইসি সচিবালয়ের সব কর্মকর্তাকে এবং আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়ে বসেছিলাম। কমিশনাররা আজ থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন ও সভার শেষ দিকে তারা ছিলেন। কাজের অগ্রগতির পাশাপাশি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
সচিব বলেন, ‘নির্বাচনের আপ টু বটম, মালামাল ক্রয় থেকে শুরু করে ভোটকেন্দ্র স্থাপন পর্যন্ত- সব বিষয়ে রোডম্যাপ অনুযায়ী সব কাজের নির্দেশনা দিয়েছেন, যেন ঘোষিত রোডম্যাপ থেকে আমরা পিছিয় না পড়ি। নির্বাচনের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে মাঠপর্যায় থেকে আমরা জানতে চেয়েছি, ব্যালট বক্সগুলো কোথায় আছে, কীভাবে আছে। সেগুলোকে কীভাবে যাচাই করে তারা আমাদের রিপোর্ট দেবে- সে বিষয়েও বলা হয়েছে।’
আরপিও নিয়ে ইসি সচিব বলেন, ভোটের ফল গেজেট প্রকাশের পর বাতিল করার ক্ষমতা নয়, বরং গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে প্রমাণ পেলে ফল প্রকাশের আগেই ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখার সুপারিশ করেছে নির্বাচন কমিশন।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে গত মঙ্গলবার আরপিও সংশোধনসংক্রান্ত প্রস্তাবের নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। তা আরও পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে ফের সভায় উঠবে।
ইসি সচিব আরও জানান, আরপিও সংশোধনের বিষয়ে অনেকেই ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, মিডিয়াতে দুটি বিষয়ে ভিন্ন রকম প্রতিবেদন এসেছে। একটি বিষয় হচ্ছে- যদি কোথাও গুরুতর অনিয়মের কারণে নির্বাচন স্থগিত করতে হয়, নির্বাচন কমিশন করতে পারেন, এটা আগে থেকে বলা আছে। এখন (সংশোধনী প্রস্তাবে) বলা হয়েছে, কোনো একটি ফল তৈরির সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা বিবরণী কমিশনে পাঠাবে, তখন যদি গুরুতর কোনো অনিয়ম হয়, তখন নির্বাচন কমিশন যথাযথ তদন্ত করবে। তদন্তে ফল সঠিক হলে তা প্রকাশ করবে। অন্যথায় গুরুতর অপরাধে ফল সঠিকভাবে প্রতিফলিত না হলে তখন তারা বাতিল করতে পারবেন। এখানে প্রজ্ঞাপনের পরে বাতিল করা হবে- কথাটা কিন্তু তা নয়।
ইসি সচিব জানান, সংসদ নির্বাচনে এখন প্রতি জেলায় একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়, যিনি জেলা প্রশাসক বা অন্য কেউ হতে পারেন। এ রিটার্নিং কর্মকর্তা জেলার আওতাধীন সব আসন তদারকি করেন। কিন্তু কোনো উপনির্বাচন হলে একটি আসনের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হয়। সে জন্য আইনে জেলা শব্দের পাশাপাশি সংসদীয় আসন যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যার বিষয়ে সচিব জানান, এটাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। প্রকৃত বিষয় হচ্ছে জেলা (ডিস্ট্রিক্ট) শব্দটির সঙ্গে অথবা আসন (কনস্টিটিউয়েন্সি) শব্দটি যোগ করা হয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রেই আইনের ধারাটা না পড়েই ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে।
নীতিগত অনুমোদনের বিষয়ে মো. জাহাংগীর আলম বলেন, ‘স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, আরপিও সংশোধন নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে। সেখানে ইসির প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। নীতিগত অনুমোদন বলতে যে প্রস্তাবনাগুলো আছে, সেগুলো আইন মন্ত্রণালয় আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখবে। তারপর পরবর্তী সভায় উত্থাপন করবে। কোন অংশ বাতিল বা কোনটা রাখা হবে, সেটা কিন্তু নীতিগত অনুমোদনের সময় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় না।’
এদিকে বিএনপির মতো সংলাপ না করা আরও আটটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য চিঠি দিয়েছে ইসি। গতকাল দলগুলোকে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও) পাঠানো হয়। এসব দল ইসির গত জুলাইয়ের আনুষ্ঠানিক সংলাপ বর্জন করেছিল।
এর আগে গত ২৩ মার্চ বিএনপিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। ইসির পক্ষ থেকে লিখিতভাবে বিএনপির অবস্থান জানতে চাওয়া হয়েছিল। বিএনপি চাইলে তাদের জোটভুক্ত সমমনা দলকে সঙ্গে নিয়েও আলোচনায় বসতে পারে বলেও ইসির ওই অনানুষ্ঠানিক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে দলটি ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তারা ইসির সঙ্গে বসবে না। চিঠির আনুষ্ঠানিক জবাবও দেবে না। এর মধ্যে আগের সংলাপ বর্জন করা বাকি আট দলকে চিঠি পাঠানো হলো। দলগুলো হলো- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ মুসলীম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।
ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) অনানুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তাবাহকের মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হয়েছে। দলগুলো আগের সংলাপে আসেনি।