২৮ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৩:৪৫:০৬ পূর্বাহ্ন


শেষ পর্যন্ত দেশীয় কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৩-২০২৩
শেষ পর্যন্ত দেশীয় কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত দেশীয় কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত


আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় কয়লা উত্তোলন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দিনাজপুরের দীঘিপাড়া কয়লা খনির সবধরনের সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। একই সাথে বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তোলন বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সমীক্ষায় দেখা গেছে, দীঘিপাড়া খনিতে যে পরিমাণ কয়লা রয়েছে তা থেকে ৩০ বছরে ৯ কোটি টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হবে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। খনিটির নির্মাণ কাজ এখন নির্ভর করছে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের সিদ্ধান্তের ওপর। সরকার চূড়ান্ত অনুমোদন দিলেই নির্মাণ কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেয়াসহ খনি উন্নয়নে অন্যান্য কাজ শুরু করা হবে।
এ বিষয়ে বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির এমডি সাইফুল ইসলাম সরকার গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন এই মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ কয়লা উত্তোলন করা হয়। ১৩০৬ নং ফেইসের কয়লা উত্তোলন শেষ হয়েছে। এখন ১৩০৬ নং ফেইস থেকে যন্ত্রপাতি খনির ১১১৩ নং ফেইসে স্থাপন করা হচ্ছে। এ কাজ শেষ সম্পন্ন হতে আরো কিছু দিন সময় লাগবে। তিনি আশাা করেন, আগামী মে মাসের মাঝামাঝি থেকে নতুন ফেইস থেকে কয়লা উত্তোলন করা যাবে। কয়লা উত্তোলন বাড়ানোর নির্দেশনা আছে। তিনি বলেন, বড় পুকুরিয়া কয়লা খনিতে প্রতিদিন ৩ হাজার ৩০০ টন কয়লা উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। আমরা এখন থেকে ৫ হাজার টন পর্যন্ত উত্তোলন করছি। তবে দীঘিপাড়া কয়লা খনির সবধরনের সমীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন খনির নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে। তবে তার আগে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের অনুমোদন লাগবে। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক থেকে অনুমোদন পাওয়া গেলে খনির নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে। তিনি বলেন, দীঘিপাড়া খনি থেকে ৩০ বছরে ৯০ মিলিয়ন বা ৯ কোটি টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন কয়লার সর্বনি¤œ দর রয়েছে ২৫০ মার্কিন ডলার। যদিও আদানির কাছ থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি টন কয়লার দাম নেবে ৪০০ মার্কিন ডলারের ওপরে। সর্বনিম্ন দর আড়াইশ ডলার হলেও এ খনি থেকে যে পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করা হবে তা বর্তমান বাজারমূল্য হবে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। এতে এক দিকে দেশীয় কয়লা ব্যবহার করে সাশ্রয়ী দরে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। অপরদিকে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে পরিবেশের ক্ষতি হবে এটা ঠিক। তবে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারলে সেটা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে। এ জন্যই ২০১২ সালে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা হবে তার ৫০ শতাংশ জোগান দেবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রথমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ১৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপানের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। তবে ১৯টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিলেও এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে কয়লা প্রয়োজন হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়নি। বিভিন্ন দেশের সাথে কয়লা আমদানির জন্য যে দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি করতে হয় সে বিষয়ে অনুমোদন নিতে কোনো পক্ষ থেকেই উদ্যোগ নেয়নি। কয়লার জোগানের নিশ্চয়তা না করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে বড় অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে। আর এ কারণে তড়িঘড়ি করে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে- এ অজুহাতে ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প বাতিল করে দেয়া হয়। ১১টি বাতিল করার পরও বর্তমান ৬ থেকে ৭টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এগুলো ধাপে ধাপে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসবে এবং এগুলো যদি উৎপাদনে আসে তাহলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মেগাওয়াট হবে।
ইতোমধ্যে রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট উৎপাদন ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে। আর এ ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে প্রতিদিন ৫ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন হবে। হিসাব অনুযায়ী এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন চালানোর জন্য প্রতিদিন সাড়ে সাত টন কয়লার প্রয়োজন। আর এ হিসাবে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা হবে কয়েক বছরে ৬ হাজার মেগাওয়াট। আর এ ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতিদিন কয়লার প্রয়োজন হবে ৪৫ হাজার টন কয়লা। যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হবে বিদেশ থেকে। আদানি গ্রুপের সাথে অসম চুক্তির কারণে প্রতি টন কয়লা ৪০০ ডলার নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এটি বাদ দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন কয়লার মূল্য আড়াই শ’ ডলার রয়েছে। এ হিসেবে ৪৫ হাজার টন কয়লা আমদানি করতে প্রতিদিন ব্যয় হবে এক কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রতিদিন ব্যয় হবে প্রায় ১১৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসেবে)। বছরে ব্যয় হবে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা। এতে অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে।
আর এ কারণেই নীতিনির্ধারক থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, দেশের মধ্যে যে কয়লা মজুদ আছে তা থেকে উৎপাদন বাড়াতে। এ জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কয়লার উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে কয়লা উৎপাদন ৫ হাজার টন উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে বড় পুকুরিয়া কয়লাখনির সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এটি নিশ্চিত করতে সবধরনের কারিগরি সহয়তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
কয়লা উত্তোলন বাড়াতে দীঘিপাড়া কয়লা খনির সব ধরনের সমীক্ষা শেষ করা হয়েছে। এখন সরকার নীতিগতভাবে অনুমোদন দিলেই কয়লাখনির নির্মাণকাজসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
দেশের কয়লাখনির প্রাক-সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, জামালগঞ্জ কয়লার খনিতে মজুদ রয়েছে ৫৫০ কোটি টন। এখন এর অর্ধেকও যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে চলমান মজুদ থেকে উত্তালন করেই বাংলাদেশের আড়াই শ’ কোটি টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। বর্তমানে যে পরিমাণ কয়লার চাহিদা রয়েছে, তা দিয়ে জামালগঞ্জের মজুদ থেকে কয়লা উত্তোলন করলে ১৫২ বছরের চাহিদা এই জামালগঞ্জ থেকেই মেটানো সম্ভব হবে। এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন কেন করা হচ্ছে না তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের কয়লার খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করতে হবে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে। দিনাজপুর বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে যে কয়লার উত্তোলন করা হচ্ছে তা ভূগর্ভের বা সুড়ঙ্গ ব্যবস্থার মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু জামালগঞ্জের ক্ষেত্রে তা করা সম্ভব হবে না। বড় ধরনের কয়লার উৎপাদন কখনো সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে হয়না। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হলে সরকারের অনেক বড় এলাকা অধিগ্রহণ করতে হবে। এবং ওই জায়গার মানুষদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে। খরচের একটি বড় বিষয় আছে। আর এ কারণে সরকার উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে চায় না। তবে তাদের মতে আমাদের কয়লার খনিতে অর্থ ব্যয় করা কোনো ক্ষতি নয়, বরং দেশের জন্য বিনিয়োগ। বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করতে হলে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে। আর সেই জায়গায় দেশীয় কয়লা ব্যবহার করা হলে এক দিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, অন্য দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতেও ব্যয় কম হবে। অন্য দিকে বিদেশে যদি কয়লার দাম প্রতিটিন ১ হাজার ডলারও হয় তাতেও আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে না, বরং আমাদের সাশ্রয়ী জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষমতা বাড়বে।
প্রসঙ্গত, বড়পুকুরিয়ার মধ্যে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে তা থেকে আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাই। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ থেকে ৬ টাকা হবে। যেখানে আদানি থেকে বিদ্যুৎ আনতে আমাদের প্রতি ইউনিটের জন্য ব্যয় হবে ১৫ থেকে ২০ টাকা। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগানো গেলে আদানির মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাড়তি মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে হতো না। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশীয় কয়লা উত্তোলন করা হলে এক দিকে প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, অন্য দিকে দেশের সম্পদ যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে আরো গতিশিল করতে সহায়তা করবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।