২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ভোর ৬টায় সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জাতীর উদ্দেশে বক্তৃতায় কিভের বিরুদ্ধে ‘সামরিক অভিযানের’ ঘোষণা করেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইউক্রেনের ‘নির্দিষ্ট ৭০টি লক্ষ্যে’ (মস্কোর বিবৃতি অনুযায়ী) ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান হামলা চালিয়েছিল রুশ বাহিনী।
পাশাপাশি, স্থল এবং জলপথেও শুরু হয়ে যায় আগ্রাসন। ডনবাস-রাশিয়া সীমান্তের পাশাপাশি, বেলারুশে মোতায়েন রুশ ট্যাঙ্ক এবং সাঁজোয়া ব্রিগেডগুলি হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে ইউক্রেনের মাটিতে। পাশাপাশি, ইউক্রেনের উপকূলবর্তী শহর ওডেসা এবং মারিয়ুপোল দখলের লক্ষ্যে ক্রাইমিয়া বন্দর এবং কৃষ্ণসাগরে মোতায়ন রুশ রণতরী এবং ‘অ্যাম্ফিবিয়ান ল্যান্ডিং ভেহিকল’ থেকে সেনা অবতরণ শুরু হয়ে যায়।
রুশ হামলার দ্বিতীয় দিনেই পতনের মুখে দাঁড়িয়েছিল ইউক্রেনের পরিত্যক্ত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র চেরনোবিল। ‘সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে পরিচিত ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল রুশ ফৌজ। এমনকি, বেলারুশ সীমান্ত পেরিয়ে আসা রুশ বাহিনীর একাংশ পৌঁছে গিয়েছিল রাজধানী কিভের শহরতলিতে! সীমিত ক্ষমতা নিয়েও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সেনা রুখে দাঁড়িয়েছিল সে সময়। প্রাথমিক একতরফা হানা পরিণত হয়েছিল পুরদস্তুর যুদ্ধে। এক বছরে পা দিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এক বছর পরে আজ পরিস্থিতি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে? অকিঞ্চিৎকর সামরিক শক্তি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে এক বছর ধরে ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে কতটা সাফল্য পেয়েছে ‘মহাশক্তিধর’ রাশিয়া?
পশ্চিমি দুনিয়ার পরিসংখ্যান বলছে (যা মানতে নারাজ মস্কো) এক বছরের যুদ্ধে রাশিয়ার এবং ইউক্রেনের এক লক্ষের কাছাকাছি সেনা নিহত হয়েছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব বলছে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমবর্ষণে নিহত হয়েছেন নারী, শিশু-সহ অন্তত ৮ হাজার সাধারণ ইউক্রেনীয় নাগরিক। আহতের সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। যদিও জ়েলেনস্কি সরকারের দাবি, হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেকটাই বেশি।
পাশাপাশি, রুশ সেনার হাত থেকে পুনর্দখলের পরে বুচা, ইজ়িয়ুম, বোরোডিয়াঙ্কা, চেরনিহিভের মতো শহর থেকে একের পর এক গণকবরের সন্ধান মিলেছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে রুশ সেনা এবং তার সহযোগী চেচেন মিলিশিয়া, ওয়াগনার ভাড়াটে বাহিনীর বিরুদ্ধে উঠেছে গণহত্যার অভিযোগ। যা নিঃসন্দেহে পুতিন সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষে অস্বস্তিকর।
গত বছরের ৪ জুন যুদ্ধের ১০০তম দিনে জ়েলেনস্কি জানিয়েছিলেন, তাঁর দেশের ২০ শতাংশ এলাকা রুশ বাহিনীর দখলে। যুদ্ধের ৩৬৫ দিন পার হওয়ার পরেও সামগ্রিক চিত্রটা বিশেষ বদলায়নি। গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভিযান ঘোষণার এক দিন আগেই পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস (পূর্ব ইউক্রেনের ডনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলকে একত্রে এই নামে ডাকা হয়) এলাকাকে ‘স্বাধীন’ বলে ঘোষণা করেছিলেন পুতিন। গত তিন মাসে ওই অঞ্চলের কিছু জনপদ রুশ সেনার দখলে এসেছে। ‘লাভ’ বলতে এটুকুই।
গত বছরের ৪ জুন যুদ্ধের ১০০তম দিনে জ়েলেনস্কি জানিয়েছিলেন, তাঁর দেশের ২০ শতাংশ এলাকা রুশ বাহিনীর দখলে।
বাখমুট থেকে ক্রামাতোরস্ক পর্যন্ত ডনবাসের বহু শহরেই প্রবল শীতে মরণপণ লড়াই চলছে দু’পক্ষের। অথচ পূর্ব ইউক্রেনের ওই অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশ বংশোদ্ভূতেরা। তাঁদের উপর ‘ইউক্রেনের অত্যাচার’কে সামরিক অভিযানের অন্যতম ‘কারণ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল মস্কো। যুদ্ধের গোড়া থেকেই ডনবাসে সক্রিয় সশস্ত্র রুশ মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পুতিন বাহিনীকে মদত দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চূড়ান্ত জয় অধরা থেকে গিয়েছে।
আবার সেপ্টেম্বরে ‘গণভোট’ করে ‘স্বাধীন’ ঘোষণার পরেও মস্কোর হাতছাড়া হয়েছে দক্ষিণ ইউক্রেনের খেরসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। যার জেরে রুশ নিয়ন্ত্রিত ক্রাইমিয়ার নিরাপত্তাও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সামরিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই। সম্ভবত সেই আশঙ্কা থেকেই পুতিন সম্প্রতি ক্রাইমিয়ায় ‘পশ্চিমী আগ্রাসনের’ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে পুতিনের লাভের ভাঁড়ার ‘শূন্য’। রাষ্ট্রপুঞ্জে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রতিটি ভোটাভুটির ক্ষেত্রের প্রমাণিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জনমত মস্কোর বিপক্ষে। যদিও ভারত, চিনের মতো দেশ সরাসরি পশ্চিমি কূটনৈতিক উদ্যোগ সমর্থন না করে ভোটদানে বিরত থেকেছে।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পক্ষে পুতিনের আর এক ‘অজুহাত’ ছিল, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নেটোতে যোগদানের বিষয়ে জ়েলেনস্কি সরকারের তৎপরতা। কিভ যদি নেটোতে যোগদান না করার বিষয়ে প্রকাশ্যে আশ্বাস দেয়, তবে সামরিক হস্তক্ষেপে ইতি টানার বার্তাও দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সেই রক্তচক্ষু গ্রাহ্য না করে নেটো-সখ্যের নীতিতে অটল রয়েছে ইউক্রেন। আর সেই সাহসই সংক্রমিত হয়েছে রাশিয়ার অন্য দুই প্রতিবেশী ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের মধ্যে। রাশিয়ার হুমকি উপেক্ষা করেই নেটোতে যোগদানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা।
ইতিমধ্যেই জার্মানির ‘লেপার্ড’ ট্যাঙ্ক, আমেরিকার ‘স্ট্রাইকার’ সাঁজোয়া গাড়ি ও প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র বিরোধী ব্যবস্থা, এস্তোনিয়ার ১৫৫ মিলিমিটার কামান মেলার আশ্বাস পেয়ে গিয়েছেন জ়েলেনস্কি। রুশ সুখোই-৩০, মিগ-৩৫ হানার মোকাবিলায় ইউক্রেনকে চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ। ইতিমধ্যেই রুশ বাহিনীর মোকাবিলায় আমেরিকার দেওয়া ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাঙ্ক ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র ও ‘স্ট্রিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ফ্রান্সের ‘সিজার’ সেল্ফ প্রপেল্ড হাইইৎজার, ব্রিটেনের চ্যালেঞ্জার ট্যাঙ্ক ব্যবহারে সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেন সেনা। পশ্চিমি দুনিয়ার নয়া অস্ত্র পেয়ে গেলে যুদ্ধের মোড় অনেকটাই ঘুরে যেতে পারে।
অন্য দিকে, রুশ বাহিনীতে যে ক্রমশ অস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাব বাড়ছে, চিন, ইরানের মতো দেশের দ্বারস্থ হওয়া থেকেই তা স্পষ্ট। তাই কি বর্ষপূর্তির এক মাস আগে থেকেই ‘পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কার’ কথা বলে রেখেছেন পুতিন?