মুমিন জীবনের অন্যতম কামনা ও লক্ষ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। আর তা করতে হয় ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে। অনেক নফল আমলের মাধ্যমে। আল্লাহর দরবারে মুমিনের ইবাদত কবুল হলেই সে সফল। দুনিয়া ও পরকালের জীবনে সফল হওয়ার জন্য কবুলযোগ্য ইবাদতের বিকল্প নেই। ইবাদত কবুলের জন্য কিছু শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। সেগুলো কী?
ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি নফল পর্যায়ের জিকিরের মাধ্যমে বেলায়াত অর্জনের আগে মুমিনকে আরো অনেক কর্ম করতে হয়। যেগুলোর অবর্তমানে সকল জিকির অর্থহীন ও ভন্ডামিতে পরিণত হতে পারে। এগুলো হলো ইবাদত কবুলের শর্ত পূরণ। জিকিরের ন্যূনতম বা পরিপূর্ণ ফজিলত অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ও আলোচনা করা জরুরি। মহান আল্লাহর কাছে ইবাদত কবুলের শর্ত পূরণের তাওকিক ও কবুলিয়্যত প্রার্থনা করি।
কোরআন কারীম ও সুন্নাতের আলোকে জিকিরসহ সকল ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল বা গৃহীত হওয়ার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত রয়েছে। তাহলো-
১. বিশুদ্ধ ঈমান ও ইখলাস: শিরক, কুফর ও নিফাক-মুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান সকল ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত। শুধু তাই নয়। উপরন্তু ইবাদতটি পরিপূর্ণ ইখলাসের সাথে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো রকম উদ্দেশ্যর সামান্যতম সংমিশ্রণ থাকলে সে ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না।
২. সুন্নাতের অনুসরণ: ইবাদতটি অবশ্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত, রীতি ও তাঁর শিক্ষা অনুসারে পালিত হতে হবে। যদি কোনো ইবাদত তাঁর শেখানো ও আচরিত পদ্ধতিতে পালিত না হয়, তাহলে যত ইখলাস, আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতাই থাক না কেন, তা আল্লাহর দরবারে কোনো অবস্থাতেই গৃহীত বা কবুল হবে না।
৩. হালাল খাবার খাওয়া: ইবাদত পালনকারীকে অবশ্যই হালাল-জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। হারাম ভক্ষণকারীর কোনো ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।
মনে রাখতে হবে
আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের সাক্ষ্য দেওয়া বা এই দুটি বিষয়ে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করাই ইসলামের মূল ভিত্তি। ঈমানের প্রথম অংশ (আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য বা মাবুদ নেই) এই সাক্ষ্য প্রদান করা। দ্বিতীয় অংশ (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসুল) এই সাক্ষ্য প্রদান করা। প্রথম অংশকে সংক্ষেপে ‘তাওহিদ’ ও দ্বিতীয় অংশকে সংক্ষেপে ‘রিসালাত’ বলা হয়।
কুরআন-হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, তাওহিদের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। প্রথমত, জ্ঞান পর্যায়ের তাওহিদ। এই পর্যায়ে মহান আল্লাহকে তাঁর গুণাবলী ও কর্মে এক ও অদ্বিতীয় বলে বিশ্বাস করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, আল্লাহই এই মাহবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, পরিচালক, সংহারক, রিযিকদাতা ও পালনকর্তা। এ সকল কর্মে তাঁর কোনো শরীক বা সমকক্ষ নেই।
দ্বিতীয়ত, কর্ম পর্যায়ের একত্ব বা ইবাদতের একত্ব। এ পর্যায়ে বান্দার কর্মে আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা হয়। অর্থাৎ বান্দার সকল প্রকার ইবাদাত বা উপাসনা আরাধনা মূলক কর্ম যেমন প্রার্থনা, সাজদা, জবাই উৎসর্গ, মানত, তাওয়াক্কুল, ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহর জন্য করা ও আল্লাহরই প্রাপ্য বলে বিশ্বাস করা এই পর্যায়ের তাওহিদ।
তাওহিদের এই দুইটি পর্যায় একে অপরের সম্পূরক ও পরস্পরে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়কে পৃথক করা যায় না বা একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির উপর ঈমান এনে মুসলিম হওয়া যায় না। তবে এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, ঈমানের প্রথম অংশ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ )-তে মূলত দ্বিতীয় পর্যায় বা “তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ্”-র বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়নি যে (লা খালিকা ইল্লাল্লাহ ) অর্থাৎ (আল্লাহ ছাড়া কোন স্রষ্টা নেই,), বা (লা রাযিকা ইল্লাল্লাহু) অর্থাৎ (আল্লাহ ছাড়া কোন রিজিকদাতা নেই)। অনুরূপভাবে আল্লাহ ছাড়া কোন জীবনদাতা নেই, মৃত্যুদাতা নেই, পালনকর্তা নেই ইত্যাদি বিষয়ে সাক্ষ্য দানের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বরং আমাদের এই ঘোষণা দিতে হবে, এই বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য বা মাবুদ নেই।
এজন্য ইসলামে ইবাদতের তাওহিদের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মূলত এর মাধ্যমেই ঈমান ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়।
আল্লাহর একত্বে বা তাওহিদের বিশ্বাসের ৬টি দিক রয়েছে, যেগুলোকে আরকানুল ঈমান বা ঈমানের স্তম্ভ বলা হয়। ১. আল্লাহর উপর বিশ্বাস, ২. আল্লাহর মালাইকা বা ফেরেশতাগণের উপর বিশ্বাস, ৩. আল্লাহর গ্রন্থসমূহের উপর বিশ্বাস, ৪. আল্লাহর প্রেরিত নবি- রাসুলগণের উপর বিশ্বাস, ৫. আখেরাতের উপর বিশ্বাস, ৬. আল্লাহর জ্ঞান ও নির্ধারণ বা তাকদিরে বিশ্বাস।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইবাদত কবুলের শর্তগুলো যথাযথভাবে পূরণের মাধ্যমে আমলি জিন্দেগি যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।