মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে মূল্যায়ন করছে আর্থিক খাতের অন্যতম আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশের সাফল্য এবার বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবে সংস্থাটি।
চলতি অর্থবছরে ৫০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা দেবে বিশ্বব্যাংক। এছাড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা, চিকিৎসা, মন্দা মোকাবিলা, ঢাকা সবুজায়ন ও জলবাযু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় নতুন করে ঋণ সহায়তার ঘোষণা দেবে বিশ্বব্যাংক।
শুধু তাই নয়, দীর্ঘ এই সময়ে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে বিভিন্ন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সহজশর্তের ঋণ সহায়তার বিষয়টি নিয়েও ফের আলোচনা করা হবে। উদ্যাপন করা হবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব। এ লক্ষ্যে চলতি সপ্তায় সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি, অপারেশন) আক্সেল ভার ট্রোটসেনবার্গ ঢাকায় আসছেন। তার এই সফরের সময় বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অবদানের বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। এছাড়া বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ইআরডি সচিব শরিফা খানসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
বিশ্বব্যাংকের মতে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে চমকপ্রদ উন্নতি করেছে। মহামারি করোনা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, সবাইকে বিনামূল্যে করোনার টিকা প্রদান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো চলমান সঙ্কট সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও এই সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, ডলার সঙ্কটে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। শুধু তাই নয়, ধারাবাহিকভাবে ভালো জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় সামাজিক সূচকেও উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের সদস্য হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশে সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিয়ে আসছে। বিশেষ করে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের অবকাঠামোতে সংস্থাটির ঋণ অবদান সবচেয়ে বেশি।
তবে দুর্নীতির অভিযোগ এনে দেশের আত্মমর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয় বিশ্বে। সেই সঙ্কট কাটিয়ে উঠে এবার ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসতে চায় বিশ্বব্যাংক। ইতোমধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ও চালু করেছে সরকার। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সংস্থার কার্যক্রম বাংলাদেশে প্রশংসিত হয়েছে। তবে সংস্থাটির বেশকিছু শর্তের কারণে বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বাড়ায় সমালোচনাও কম নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ অবস্থায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অবদানের বিষয়টি জাতির কাছে তুলে ধরার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান উদ্যাপন করা হবে। বিশ্বব্যাংকের এই আয়োজনে খুশি অর্থ মন্ত্রণালয়। বিশ্বব্যাংকের এমডির সৌজন্যে আগামী ২২ জানুয়ারি রবিবার রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ে নৈশভোজের আয়োজন করেছে অর্থবিভাগ। অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত আনুষ্ঠানিক দাওয়াতপত্র ইতোমধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সচিবালয়ে জানান, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী ও ঋণদাতা সংস্থা। চলতি বছর সংস্থাটি বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ প্রদান করবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা, সবুজ নগরায়ন, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে তারা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। চলমান বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবিলায়ও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগ ও ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন ॥ স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে বিশ্বব্যাংকের অবদানের বিষয়টি আবার জাতির সামনে নিয়ে আসতে চায় সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের পাশে থাকবে বিশ্বব্যাংক। এ কারণে বিশ্বব্যাংক ও ইআরডির যৌথ উদ্যোগে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চায়। পদ্মা সেতু থেকে সরে যাওয়ার পর সংস্থাটি সম্পর্কে বাংলাদেশে এক ধরনের নেতিবাচক প্রপাগান্ডা রয়েছে। এবার আরও বিনিয়োগ ও সহায়তা দিতে চাচ্ছে সংস্থাটি।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের অবদান অনস্বীকার্য। তবে পদ্মা সেতু ঘটনার পর সংস্থাটি বেশ চাপে ছিল। এখন আবার সংস্থাটি বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও ঋণ সহায়তায় এগিয়ে আসছে। এটি ভালো লক্ষণ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে বিশ্বব্যাংকের এমডি মর্যাদার একজনের বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে নতুন বিনিয়োগ ও সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার সুযোগ বাড়বে।
ইআরডির তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৭৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে। পাইপলাইনে রয়েছে ৪৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুত ঋণ-অনুদান সাড়ে ৩৭ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়ন সহযোগীদের এসব ঋণ-অনুদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। যার পরিমাণ প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশকে এ পর্যন্ত ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ঋণ ছাড় করেছে ২১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) থেকে নমনীয় শর্তে ঋণ প্রদান করা হয়। আইডিএর অন্যতম বড় ঋণগ্রহীতা বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে এত পরিমাণে ঋণ-অনুদান কোনো উন্নয়ন সহযোগী দেয়নি, যা মোট ঋণ-অনুদানের ২৩ শতাংশ। গড়ে এখন বছরে দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশকে চলমান ৫৫টি প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক এক হাজার ৫শ’ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক।
সম্প্রতি তিনি ঋণ সংক্রান্ত এক আলোচনায় জানান, বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংক খুশি। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিডের প্রভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ অর্থনীতির চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি আরও বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি, আর্থিক খাত শক্তিশালী করা এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে টেকসই করতে পারে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে পুরোপুরি সহায়তা দেবে।
বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) ৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার আশা করছে সরকার। এই ৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ২৫ কোটি ডলার শীঘ্রই পাওয়া যাবে। এ ছাড়া আইডিএ থেকেও ৬০০ কোটি ডলারের বেশি পেতে পারে বাংলাদেশ। এদিকে, এশিয়ার যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক ভালো বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের নবনিযুক্ত বাংলাদেশের প্রধান আবদুলায়ে সেক।