মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আছে এমন একটি জাহাজের নাম ও রঙ পাল্টে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য নিয়ে এসেছে রাশিয়া।জাহাজটিকে বন্দরে পণ্য খালাসের অনুমতি দিতে রাশিয়া চাপ দিলেও বাংলাদেশ জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে দেয়নি।
বাংলাদেশের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, উরসা মেজর নামের রাশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য নিয়ে ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। এর আগেই ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জানায় যে ওই জাহাজ আসলে ‘উরসা মেজর' নয়, সেটা মূলত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ‘স্পার্টা ৩' জাহাজ।
রঙ ও নাম বদল করে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজে করে পণ্য আসছে-এটি নিশ্চিত হওয়ার পর বাংলাদেশ সেটিকে বন্দরে ভিড়তে নিষেধ করে দেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি জাহাজের একটি নম্বর থাকে, যেটি তারা পরিবর্তন করেনি। ফলে বিষয়টি ধরা পড়ে যায়।
ঢাকার এই অবস্থানকে ‘একদম গ্রহণযোগ্য নয়' বলে রাশিয়া কূটনৈতিক চিঠির মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তবে রাশিয়ার প্রস্তাব গ্রহণ না করে জাহাজটিকে দেশে ফেরত যেতে বলেছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নিষেধাজ্ঞা থাকা জাহাজ দেশে প্রবেশ করতে দিলে সেই দেশের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। সেদিক থেকে সরকারের অবস্থান যুক্তিযুক্ত।
এ বিষয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, "নিষেধাজ্ঞা বিষয়টি আইনগত। মার্কিন আইন অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-এমন জাহাজ ব্যবহার করা করা হলে যারা করবে, তাদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। এটি একটি কিছুটা ঝুঁকিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু রাশিয়ার ওই জাহাজ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছে, তাই সরকার সেটিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে দেবে না। ওই জাহাজের পণ্য ছোট জাহাজে করে বাংলাদেশে আনতে হবে-এ কথা জাহাজটির স্থানীয় এজেন্টকে জানানোর পর থেকেই রাশিয়া এ নিয়ে দেনদরবার শুরু করেছে।
এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) মো. খুরশেদ আলমের দপ্তরে ডাকা হয়। এ সময় রুশ রাষ্ট্রদূতকে বলা হয় যে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রকল্প এলাকায় নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহনের দায়িত্ব এজেন্টের। এ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি রাশিয়াকে সুরাহা করতে হবে। বাংলাদেশ ওই জাহাজকে বন্দরে ভিড়তে দেবে না।
একই দিন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে রূপপুর প্রকল্পের পণ্যবাহী জাহাজকে বাংলাদেশকে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। ওই বৈঠকে রাশিয়ার প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান ঘিরে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে নতুন করে যে ‘শীতল যুদ্ধ' শুরু হয়েছে, সম্প্রতি তার রেশ এসে পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের মানবাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বক্তব্য এবং বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিবৃতির বিষয়টি ইতিমধ্যে আলোচনায় এসেছে। এর মধ্যেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আছে, এমন একটি রুশ জাহাজের নাম পাল্টিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য নিয়ে আসার ঘটনা জানা গেল।
নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যেভাবে জানা গেলো
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পণ্যবাহী উরসা মেজর নামধারী জাহাজটি ভারতের কেরালা রাজ্যের কোচিন বন্দরে সেখানকার কিছু পণ্য খালাস করে। এরপর রূপপুরের পণ্য নিয়ে জাহাজটি বাংলাদেশের মোংলা বন্দর অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।
২০ ডিসেম্বর ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস এক কূটনৈতিক পত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায় যে উরসা মেজর নামের ওই জাহাজ আসলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা স্পার্টা ৩। জাহাজটির রঙ ও নাম পরিবর্তন করা হলেও এর আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা সনদ নম্বর ৯৫৩৮৮৯২, যা প্রকৃত পক্ষে ‘স্পার্টা ৩'-এর নম্বর। কূটনৈতিক পত্রে বলা হয়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ওই জাহাজে পণ্য ওঠানো-নামানো, জ্বালানি সরবরাহ, জাহাজের নাবিকদের যেকোনো ধরনের সহযোগিতায় যুক্ত হলে ওই দেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া বা বড় আর্থিক দণ্ডের মুখে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
জাহাজটির বিষয়ে মার্কিন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। এর ভিত্তিতে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় যে জাহাজটি ভিড়তে পারবে না।
২০ ও ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় রাশিয়ার দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুটি চিঠি পাঠায়। দুই চিঠিতেই রাশিয়া পণ্যবাহী ওই জাহাজকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুরোধ জানায়। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ার দেওয়া ২২ ডিসেম্বরের চিঠির ভাষা ছিল আক্রমণাত্মক, সেখানে রাশিয়া উল্লেখ করেছে যে জাহাজটিকে প্রবেশের অনুমতি না দিলে সেটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের আশপাশের এলাকায় রয়েছে বলে জানা গেছে। (এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের)