জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক পেনশন হিসাব খুলতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে এ পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকবে। তবে পরবর্তী সময়ে তা বাধ্যতামূলক করা হবে। ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়া সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন নাগরিকরা। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য পৃথক পেনশন হিসাব থাকবে। ফলে চাকরি পরিবর্তন করলেও এ হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। এতে প্রতিষ্ঠানেরও অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে। এসব সুবিধা রেখে শিরোনামে আংশিক পরিবর্তন এনে জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে পাস হতে যাচ্ছে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল ২০২২’। আগামী ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের ২১তম অধিবেশন বসছে।
আইনসভার অনুমোদনের জন্য গত ২৯ আগস্ট ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২২’ জাতীয় সংসদে ওঠে। বিলটি উত্থাপন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পরে সেটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জাতীয় সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। এরই মধ্যে সংসদীয় কমিটিতে যাচাই বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। এখন পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিলের খসড়ায় শিরোনাম ছিল ‘জনগণের বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্য কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত অভাবগ্রস্ততা ও দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাভুক্তিকল্পে আনীত বিল।’
জানা গেছে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনায় শিরোনামটিকে একটি গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে বলে মনে করা হয়। এর পরিবর্তে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনাকে একটি ব্যাপক রূপ দেওয়ার জন্য বিলের শিরোনাম সংক্ষিপ্ত করে ব্যাপক অর্থে ব্যবহারের জন্য নতুন শিরোনাম অর্থাৎ ‘দেশের সর্বস্তরের জনগণকে একটি টেকসই পেনশন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে আনীত বিল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হবে। এর আগে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২২-এর উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘দেশে সাধারণ জনগণের বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্য কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত অভাবগ্রস্ততা ও দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাভুক্তির জন্য কোনো আইনি বিধান নেই। সে প্রেক্ষাপটে সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের দফা (ঘ)-এর বিধান অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার ও অন্যান্য অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য লাভের অধিকারের বিধান অন্তর্ভুক্তকরণপূর্বক একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন আবশ্যক।
‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল ২০২২’ আগামী জাতীয় সংসদ অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে। জানা গেছে, ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা’ চালু করতে আলাদা একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে আইন প্রণয়নসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিলের খসড়ায় শব্দগত কিছু বিষয় সংশোধন করা হয়েছে। এটি ছাড়া পুরো কাঠামো অভিন্ন রেখে বিলটি আইনে পরিণত করতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে উপস্থাপন করা হবে। এর আগে বিলটি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করা হয়।
চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রস্তাবিত ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’র বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা’ প্রবর্তন হলে ১৮ বছর বয়সে যদি কেউ চাঁদা দেওয়া শুরু করে এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালু থাকে তাহলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা পেনশন পাবেন। যদি ৩০ বছর বয়সে চাঁদা দেওয়া শুরু করেন এবং ৬০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, তাহলে অবসরের পর তিনি প্রতি মাসে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন।
সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ্য দিক : ১৮-৫০ বছর বয়সী সব কর্মক্ষম নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের আপাতত নতুন জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সরকার যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসী কর্মীদের সুবিধার্থে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা জমা দেওয়ার সুযোগ থাকবে। সুবিধাভোগী বছরে ন্যূনতম বার্ষিক জমা নিশ্চিত করবে। অন্যথায় তার হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত হবে এবং পরে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে হিসাব সচল করা হবে। সুবিধাভোগীরা আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা হিসেবে বর্ধিত অর্থ জমা করতে পারবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা (৬০ বছর) পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন দেওয়া হবে।
পেনশনাররা আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। নিবন্ধিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করলে জমাকারীর নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের (মূল জমাকারীর বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) জন্য মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। পেনশন স্কিমে জমাকৃত অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে, যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদা প্রদানকারী মৃত্যুবরণ করলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য। অর্থাৎ কর্মী চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা প্রদান ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে। নিম্নআয়সীমা নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে প্রদান করতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। পেনশন কর্তৃপক্ষ ফান্ডে জমাকৃত টাকা নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে।