ঢাকার যানজটের দুর্নাম দুনিয়াজোড়া। সবচেয়ে সময়ানুবর্তী মানুষটিও এই নগরে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে চলতে পারেন না। যানজটে আটকে সবাই কমবেশি 'লেট লতিফ'! ৯টায় মতিঝিলে অফিস ধরতে মিরপুরের বাসিন্দাদের ঘর থেকে বেরোতে হয় দুই ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে। পথে যানজটের সঙ্গে দেখা হলে অফিসে পড়ে 'লেট মার্ক'। পথের গাড়িজট নিচ্ছে প্রাণও। অ্যাম্বুলেন্স যানজটে আটকে রোগীর মৃত্যুও দেখেছে রাজধানী ঢাকা।
দুর্বিষহ যানজট নিরসনের স্বপ্ন পূরণে আধুনিক গণপরিবহন মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে একধাপ এগোচ্ছে বাংলাদেশ। আজ বুধবার মেট্রোরেলের এমআরটি-৬ লাইনের দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও অংশের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিতে এখন প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে। মেট্রোরেলে লাগবে ১৭ মিনিট।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, শুধু ঢাকার যানজটের কারণেই বছরে আর্থিক ক্ষতি হয় ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশ। মাসে ৫০ লাখ এবং বছরে ৬ কোটি কর্মঘণ্টা খেয়ে ফেলছে যানজট। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গত বছরের ৩ এপ্রিলের গবেষণা অনুযায়ী, তা কমে এখন ঘণ্টা ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার।
শুধু কি যানজট? রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ঢাকা নগরে বছরে শতাধিক মানুষের জীবন থামে গাড়িচাপায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিপজেটের গবেষণা বলছে, যানজটের কারণে এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকায় বাস করা সবচেেেয় বেশি মানসিক চাপের ব্যাপার।
যানজটের কারণে হৃদযন্ত্র, ফুসফুসের রোগ হচ্ছে। শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মেজাজ খিটখিটে হওয়ার রোগ তৈরি করছে। এআরআইয়ের হিসাবে, যানজটের কারণে তৈরি স্বাস্থ্য সমস্যায় দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ গড়ে ৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ট্রাফিক সিগন্যালে দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
তিলোত্তমা ঢাকায় ভাঙাচোরা লক্কড়ঝক্কড় বাসের কাছে অসহায় সাধারণ যাত্রী। বেশি ভাড়ার কারণে ট্যাক্সি ও অটোরিকশা তাঁদের নাগালের বাইরে। তাই ভোগান্তিই নিয়তি। যানজট নিরসনে চেষ্টা হয়েছে অনেক। তবে সব 'টোটকা' ব্যর্থ। একের পর এক নির্মিত ফ্লাইওভারে কাজ হয়নি। বছর দুইয়েক আগে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন তৈরি করা হয় ৩৯ কোটি টাকায়। সেগুলো বন্ধ। পুরো টাকাই গেছে জলে।
অসহনীয় এই অবস্থা থেকেই মুক্তি দিতে ২০০৪ সালে প্রণীত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় ঢাকায় তিনটি মেট্রোরেল লাইন এবং তিনটি বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফলে যানজট আরও বাড়ে। ২০১৫ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন এবং দুটি বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। প্রকল্প অনুমোদনের প্রায় চার বছর পর ২০১৬ সালের ২৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমআরটি-৬ এর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেছেন, ঢাকাকে বাঁচানোর শেষ উপায় মেট্রোরেল। যানজট নিরসনে ঢাকায় এ পর্যন্ত যত প্রকল্প হয়েছে, এর মধ্যে মেট্রো একমাত্র বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা। তবে উচ্চ নির্মাণ খরচের কারণে মেট্রোতে একবারে অনেক বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়।
৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায় নির্মাণাধীন এমআরটি-৬ লাইনের উপপ্রকল্প পরিচালক আবদুল বাকি মিয়া সমকালকে বলেন, ঢাকার যানজটে প্রতিবছর যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়, তা দিয়ে তিনটি মেট্রোরেল লাইন তৈরি করা যায়। এ হিসাবে মেট্রোরেল শুধু সময়সাশ্রয়ী নয়, আর্থিক সাশ্রয়ও করবে।
মেট্রোর নির্মাণকাজের কারণে দুর্ভোগ হয় মিরপুর এলাকায়। যানজটের কারণে মিরপুর ছেড়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। সেই দুঃসময় পেছনে ফেলে চালু হচ্ছে মেট্রোরেল। আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে যাত্রী নিয়ে চলবে ট্রেন। সড়কের মাঝ বরাবর মাটি থেকে ১৩ মিটার উঁচুতে নির্মিত ভায়াডাক্টে (উড়ালপথ) চলবে অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রো। যানজটের আটকা পড়বে না। সাধারণ ট্রেনের মতো ক্রসিংয়ে পড়বে না। শত কিলোমিটার গতিতে ঘড়ির কাঁটা মেনে চলবে। যানজটের অভিশাপ থেকে মিলবে মুক্তি।
তবে এখনই যানজট থেকে মুক্ত হচ্ছে না ঢাকা। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকায় দিনে ৪ কোটি ট্রিপ হয়। এমআরটি-৬ লাইন ৪ লাখ ৮৩ হাজার ট্রিপ দিতে পারবে। অর্থাৎ, মোট ট্রিপের মাত্র ১ শতাংশের কিছু বেশি হবে ২০২৩ সালে এমআরটি-৬ লাইন পুরোপুরি চালু হওয়ার পর। তবে ২০৩০ সালে ছয়টি মেট্রোরেল চালুর পর মোট ট্রিপের ১৭ শতাংশ হবে মেট্রোতে। ততদিনের অপেক্ষায় এমআরটি-৬ এর একাংশ চালুর মাধ্যমে এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।