ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ব্যয় কমাতে কৃষি কাজে দিন দিনই বাড়ছে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার। কিছুদিন আগেও হালের বলদ, লাঙল-জোয়ালই ছিল কৃষকের মূল ভরসা। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে স্বপ্নের ফসল ফলাতো। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষিতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। জমি চাষ থেকে শুরু করে ধানের চারা রোপণ, ধানগাছ কাটা এবং মাড়াই সবই যন্ত্রের সাহায্যে হচ্ছে। নতুন নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে দেশের কৃষি খাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এসব যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কৃষকের কমেছে কায়িক পরিশ্রম ও খরচ। অপরদিকে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ এবং উৎপাদন ব্যয়ও অনেক কমেছে। কৃষিবিদরা বলছেন, দেশে দিন দিন ফসলের জমি কমে যাচ্ছে অপরদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। আর সে কারণেই অধিক জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মনজুরুল আলম বলেন, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে উৎপাদন যেমন বেড়েছে তেমনি উৎপাদন খরচও কমেছে। বলা যায় দেশের কৃষি খাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এখন প্রায় ৯০ শতাংশ ফসলের জমি পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের মাধ্যমে চাষ করা হচ্ছে। ধান মাড়াইয়ের ক্ষেত্রেও এখন যন্ত্রের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। বর্তমানে ৭০ শতাংশ ধান মাড়াই হচ্ছে যন্ত্র দিয়ে। তবে ধানগাছের চারা রোপণ এবং ধান কাটার ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। অথচ এ দুটি কাজেই এখন ধান উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে। চারা রোপণ এবং ধান কাটা পুরোপুরি যান্ত্রিকীকরণ করতে পারলে ধান উৎপাদনের খরচ অর্ধেক কমে আসবে।
লাঙল-জোয়াল আর হালের বলদের জায়গা অনেক আগেই কলের লাঙল ‘পাওয়ার টিলার’ দখল করে নিয়েছে। এরপর এসেছে কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, ইনক্লাইন্ড প্লেট সিডার, রিপার ও বেড প্লান্টার এসব আধুনিক যন্ত্র। এসব যন্ত্রের সাহায্যে ধান রোপণ থেকে শুরু করে কাটা-মাড়াই সব হচ্ছে। সর্বশেষ এবার আসছে ধানের চারা উৎপাদনের যন্ত্র। দেশে প্রথমবারের মতো জাপানের তৈরি ‘অটোমেটিক রাইস সিড সুইং মেশিন’ বা ধানের স্বয়ংক্রিয় বীজবপন যন্ত্রের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা হবে। মূলত ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ বা চারা রোপণ যন্ত্র উপযোগী এই অটোমেটিক রাইস সিড সুইং মেশিন দেশের ৩০০টি উপজেলায় সরবরাহ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এই সংস্থার অধীনে বাস্তবায়নাধীন সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প থেকে ধানের চারা উৎপাদনের এই আধুনিক যন্ত্রটি উপজেলা কৃষি অফিসগুলোতে সরবরাহ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যে আরো ২০০ উপজেলায় এই যন্ত্র সরবরাহ করা হবে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) তারিক মাহমুদুল হাসান জানান, জাপানে প্রচলিত এই বীজবপন যন্ত্রটির দাম ৫ লাখ টাকা। সরবরাহ করা প্রতি উপজেলায় তিনজন করে মোট ৭৫০ জন কৃষককে ‘অটোমেটিক রাইস সিড সুইং মেশিন’ পরিচালনা করে ট্রেতে বীজবপনে পারদর্শী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে দেশের ১৪টি ভেন্যুতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে এটা ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।
কলের লাঙল ‘পাওয়ার টিলার’ দিয়ে জমি চাষাবাদের পর যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্র দিয়ে একই সাথে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তায় ভরা যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এর ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। যন্ত্রটি ব্যবহার করলে সময় বাঁচায় ৭০-৮২ শতাংশ এবং ৭৫ শতাংশ কম শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে এক একর জমির ধান বা গম কাটতে খরচ হয় প্রায় ৬ হাজার টাকা। সেখানে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারে লাগে মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এটি অল্প কাদার মধ্যেও ব্যবহার করা যায়। একই সঙ্গে এ যন্ত্র দিয়ে ফসল কাটার পর খড়ও আস্ত থাকে।
রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্র ব্যবহার করে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিভিন্ন দূরত্বে ও গভীরতায় চারা রোপণ করা যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, নিয়ন্ত্রিত ও নিখুঁতভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণে চারা রোপণ সুবিধার কারণে যন্ত্রটির প্রতি দিন দিন আগ্রহী হয়ে পড়ছে কৃষকরা। একজন শ্রমিক ঘণ্টায় প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ জমিতে চারা রোপণ করতে পারে। যন্ত্রটি ব্যবহার করতে জ্বালানি খরচও খুব কম, ঘণ্টায় মাত্র ০.৫-০.৬ লিটার অকটেন প্রয়োজন পড়ে। যন্ত্রটি ব্যবহার করলে বীজতলা তৈরি করার জন্যও আলাদা জমির প্রয়োজন হয় না। বাড়ির উঠানেই বীজতলা তৈরি করা সম্ভব।
ইনক্লাইন্ড প্লেট সিডার এ যন্ত্রটির সাহায্যে বীজ বুনলে কম বীজ লাগে, সহজে আগাছা পরিষ্কার করা যায়, গাছ বেশি আলো বাতাস পায় এবং সর্বোপরি উৎপাদন বাড়ে। সারিতে ও নির্দিষ্ট দূরত্বে এবং গভীরতায় সহজে বীজ বোনার জন্য পাওয়ার টিলার চালিত বীজবপন যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়। এ যন্ত্র দিয়ে চাষ করা জমিও চাষবিহীন অবস্থায় বেলে ও বেলে দোআঁশ মাটিতে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, তৈলবীজ ও ডাল শস্য সারিতে বোনা যায়। এ যন্ত্রটি ব্যবহারে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ১০ থেকে ৪০ শতাংশ বীজ কম লাগে এবং ফলন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ পদ্ধতিতে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৪৫ শতাংশ জমিতে বীজবপন করা যায়।
ধান ও গম কাটার যন্ত্র ‘রিপার’। ফসল কাটার মৌসুমে এ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। এই মেশিন ব্যবহার করে ১ ঘণ্টায় ৬৬ শতাংশ জমির ধান ও গম কাটা সম্ভব এবং এখানে পেট্রল খরচ হচ্ছে মাত্র ১ লিটার। যেখানে সনাতন পদ্বতিতে প্রয়োজন হচ্ছে ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিকের, যার খরচ ন্যূনতম ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে এ যন্ত্র ব্যবহারে সাশ্রয় হচ্ছে ৯২ ভাগ খরচ, শ্রম ও সময় ব্যয় কমে প্রায় ৯০ ভাগ।
বেড প্লান্টার যন্ত্রটি বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করতে এ যন্ত্রটি ব্যবহার হয়। আলু, ভুট্টা, মরিচ, সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল, বীজ-ফারো বা বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করা হয়। বেড পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করলে বাতাস সহজেই গাছের শিকড়ের কাছে যেতে পারে। এ যন্ত্রের ব্যবহারে ১ থেকে ২টি চাষে বেড তৈরি, সার প্রয়োগ ও বীজ বপনের কাজ একই সঙ্গে করা যায়, স্থায়ী বেডেও বীজবপন করা যায়, যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ শতাংশ জমিতে বেড তৈরি করতে পারে।